যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে ‘খন্ডলের মিষ্টি’

আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আব্দুল্লাহ আল-মামুন আব্দুল্লাহ আল-মামুন ফেনী
প্রকাশিত: ১২:১১ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গরুর দুধ থেকে ছানা, ছানা থেকে তৈরি হয় রসগোল্লা। ফেনীর বিখ্যাত এই মিষ্টান্ন সর্বমহলে ‘খন্ডলের মিষ্টি’ নামে পরিচিত। প্রচলিত রসগোল্লার মতোই এর স্বাদ ও সুনাম জেলা ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে পৌঁছেছে। এটি মূলত রসগোল্লার একটি ভিন্ন সংস্করণ। যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে এ মিষ্টি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেনী শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে পরশুরাম উপজেলার ছোট্ট এক বাজারের নাম ‘খন্ডল হাই’। সত্তরের দশকে এই বাজারের নামেই নামকরণ হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী ওই মিষ্টির। সুস্বাদু এ মিষ্টি প্রথম তৈরি করেছিলেন যোগল চন্দ্র দাস।

সত্তরের দশকের শেষভাগে ভাগ্যান্বেষণে বাড়ি ছাড়েন যোগল। ভায়রার ডাকে বসতি গড়েন পরশুরামের খন্ডল হাই বাজারের পার্শ্ববর্তী বণিক পাড়ায়। শুরুতে খন্ডল হাই বাজারে ছোট্ট চায়ের দোকান খুলেন। নাস্তা খেতে আসা ক্রেতাদের জন্য কিছু মিষ্টিও তৈরি করতে থাকেন।

মোট ৫২ ধরনের মিষ্টি বানাতে পারতেন যোগল। তার মিষ্টি বানানোর পারদর্শিতার কথা জানতে পেরে তার কিছু সাগরেদও জুটে যায়। এরমধ্যে যোগল দাসের দোকানের স্পঞ্জের মিষ্টির খ্যাতি আশপাশের এলাকা ছড়িয়ে পড়ে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগল চন্দ্র দাস ব্যবসা ছেড়ে চলে গেলেও তার সাগরেদরাই ধরে রাখেন মিষ্টির ঐতিহ্য।

যোগলের সাগরেদদের মধ্যে অন্যতম কবির আহমদ পাটোয়ারী। মূলত তার হাত ধরেই খন্ডলের এই সুস্বাদু মিষ্টির সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিস্তৃত এলাকায়। বছর দুয়েক আগে মারা যান কবির আহমদ। বর্তমানে তার সন্তানরাই ধরে রেখেছেন খন্ডলের মিষ্টির ঐতিহ্যের আভিজাত্য।

যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে ‘খন্ডলের মিষ্টি’

যেভাবে তৈরি হয় খন্ডলের মিষ্টি

আশপাশের গ্রাম থেকে কলসি, প্লাস্টিকের ড্রাম, বোতল ও হাঁড়িতে করে দুধ আসে কারখানায়। প্রথমে সুতি কাপড়ে কাঁচা দুধ ছেঁকে নেওয়া হয়, এরপর চুলায় চাপানো হয় ১৭ কেজি দুধ। আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর চুলা থেকে নামানো হয় সেই দুধ। তারপর উষ্ণ দুধে টক পানি ও কিছুটা বিশুদ্ধ ঠান্ডা পানি মিশিয়ে দুধের ছানা তৈরি করা হয়। সুতি কাপড়ের মাধ্যমে ছানা আলাদা করা হয়। ১৭ কেজি দুধ থেকে পাওয়া যায় দুই কেজি ছানা।

শুকানো ছানা থেকে শুরু হয় মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে হাত দিয়ে পুরো ছানা দলা করে মেশানো হয় ২০ গ্রামের মতো ময়দা। প্রথমে ৬ লিটার পানি হালকা জ্বাল করে তাতে পাঁচ কেজি চিনি মেশানো হয়। উচ্চ আঁচে ১৫ মিনিটের মতো জ্বাল দেওয়া হয়। পরে ছেঁকে নেওয়া হয়। এরপর ফের চুলায় সিরা উঠিয়ে তাতে মিষ্টির মন্ডগুলো ছেড়ে দিয়ে আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়।

যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে ‘খন্ডলের মিষ্টি’

স্থানীয়রা জানায়, ফেনীর নানা প্রান্তে ‘খন্ডলের মিষ্টি’র অসংখ্য দোকান পাওয়া গেলেও মূলত এ বাজারের দুটি দোকানেই তৈরি হয়। দোকান দুটির একটি কবির আহম্মদ পাটোয়ারীর ‘খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা’ ও অন্যটি দেলোয়ার হোসেনের ‘খন্ডলের আসল মিষ্টি মেলা’।

খন্ডলের পাটোয়ারি মিষ্টি মেলার স্বত্বাধিকারী মো. বেলাল হোসেন বলেন, খন্ডলের মিষ্টির অন্যতম বিশেষত্ব হল প্রায় সব মিষ্টি ঠান্ডা অর্থাৎ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খাওয়া হলেও খন্ডলের মিষ্টি খাওয়া হয় গরম এবং ঠান্ডা উভয় অবস্থাতেই। রসসহ প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ১৬০ টাকায় আর রস ছাড়া প্রতিকেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ২৬০ টাকা।

যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে ‘খন্ডলের মিষ্টি’

তিনি আরও বলেন, দিনে ১৫০ কেজির মতো মিষ্টি তৈরি হয়। চাহিদা বেশি হলেও আমরা গুণমানে বিশ্বাসী। মিষ্টির মান-ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেই আমরা সন্তুষ্ট।

বক্সমাহমুদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রেজাউল করিমসহ স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, এ অঞ্চলের মানুষের কাছে খন্ডলের মিষ্টি ছাড়া কোনো ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক উৎসব অকল্পনীয় বলে বিবেচিত হয়। বিয়ে বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে খন্ডলের মিষ্টি থাকা চাই-ই। খন্ডলের মিষ্টি খেতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লাসহ দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসেন কয়েকশ মানুষ।

মিষ্টি কিনতে আসা আবু ইউসুফ মিন্টু বলেন, দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা ফেনীর প্রবাসীরা ও প্রবাসে থাকা স্বজন ও বন্ধুদের জন্য খন্ডলের মিষ্টি নিয়ে যান। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে খন্ডলের মিষ্টি নিয়ে যান প্রবাসীরা।

যেকোনো অনুষ্ঠানের তালিকায় থাকে ‘খন্ডলের মিষ্টি’

খন্ডলের মিষ্টির উদ্ভাবক যোগল চন্দ্র দাস জাগো নিউজকে বলেন, এ মিষ্টির প্রধান ও একমাত্র উপকরণ হলো গরুর খাঁটি দুধের ছানা। এখানে গোপন ফর্মুলা নেই। ভীষণ চাহিদা স্বত্বেও প্রতিদিন ১৫০ কেজির বেশি মিষ্টি তৈরি করা হয় না। কারণ তাতে মিষ্টির গুণমান কমে যায় বলে ধারণা তার।

পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে প্রতিষ্ঠানটির আরও সুনাম ছাড়িয়ে যাবে।

এসজে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।