বিলুপ্তির পথে ঘানি শিল্প

ঘানিভাঙা তেল নিতে আজও ছোটে মানুষ

রবিউল হাসান
রবিউল হাসান রবিউল হাসান লালমনিরহাট
প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রযুক্তির এই যুগে সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে মানুষের জীবন। দৈনন্দিন জীবনে যোগ হয়েছে নতুন নতুন যন্ত্র। আর সেই যন্ত্রের প্রভাবে আজ হারাতে বসেছে গ্রামের সেই ঐতিহ্য ঘানির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ।

একসময় সরিষা থেকে তেল তৈরির একমাত্র ভরসা ছিল গরুর ঘানি। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়ায় মানুষ এখন যন্ত্রকেই বেছে নিয়েছে। গরুর ঘানি বাদ দিয়ে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে অল্প খরচ ও সময়ের মধ্যেই অধিক তেল উৎপাদন করা হচ্ছে। যার ফলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঘানি শিল্প।

কালের বিবর্তনে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন অনেকে। তবে পূর্ব পুরুষের পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন কয়েকজন। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ফকির পাড়া গ্রামের তেলি শফিকুল ইসলাম (৪৫) তেমনই একজন। তার বাড়িতে আজও গরু দিয়ে ঘানি টেনে সরিষার থেকে তেল বের করে বিক্রি করা হয়।

jagonews24

পরিবারে স্ত্রী-সন্তান ও মা মিলে ৭ জন সদস্য। সম্পদ বলতে আছে দুই বিঘা জমি। অভাবের সংসার চলে ঘানির তেল বিক্রি করেই। ওই গ্রামে শুধুমাত্র তার পরিবারই এখনও ঘানি টানছে গরু দিয়ে। ঘানিভাঙা তেলের চাহিদাও ব্যাপক। তার এই খাঁটি সরিষার তেল যাচ্ছে দেশ এবং দেশের বাইরেও।

জেলা শহরের বড়খাতা ও বাউরা বাজারে সপ্তাহে দুইদিন ঘানিভাঙা সরিষার তেল বিক্রি হয়। ঘানির খাঁটি সরিষার তেলের প্রচুর চাহিদা থাকলেও বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঘানির তেল বিক্রি করে আগের মতো আর লাভ হচ্ছে না।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম ফকিরপাড়া গ্রামে টিনশেড একটি ঘরে একটি গরু ঘানি নিয়ে ঘুরছে। এতে সরিষা ভাঙছে আর ফোঁটা ফোঁটা তেল পড়ে জমা হচ্ছে পাত্রে। পাত্র ভরে গেলে তা নিয়ে মাটির কলসিতে রাখছেন তারা। চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে খাঁটি তেল। ১৫ কেজি সরিষায় পাঁচ লিটার তেল বের হয়। সরিষা থেকে তেল বের হয়ে গেলে তৈরি হয় গরুর খাদ্য খৈল।

https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/33-20230911120445.jpg

ঘানির মালিক তেলি শফিকুল ইসলাম বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে ঘানির তেল বের করে সংসার চালাচ্ছি। অত্র এলাকার তিন ইউনিয়নের মধ্যে আমার ঘানি টিকিয়ে রেখেছি। ঘানির তেল বিক্রি করেই সংসার চলছে। তেলের চাহিদা থাকলেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো আর লাভ হয় না।

তিনি বলেন, এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গরু কিনে সেটিকে ঘানির কাজে ব্যবহার করছি। এখনো এনজিওর লোন পরিশোধ হয়নি। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে এই ঘানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখবো।

তিনি আরও বলেন, অন্যান্য তেলের থেকে ঘানিভাঙা তেলের দাম বেশি এবং চাহিদাও বেশি। বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখনও ছুটে আসে ঘানির তেল কিনতে। আমার এই খাঁটি সরিষার তেল সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, তুরস্ক, কানাডাসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়।

তিনি বলেন, ঘানির তেলের ঝাঁঝ ও গন্ধ আলাদা। আমরা সব সময় খুচরা তেল বিক্রি করে থাকি। প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা এবং কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা দরে।

শফিকুল ইসলামের ভাই মমতাজ মিয়া বলেন, আমাদের চার ভাইয়ের চারটি ঘানি ছিল। তিন ভাই এই ঘানির ব্যবসা বাদ দিয়েছি। শুধুমাত্র বড় ভাই শফিকুল ইসলাম এই ঘানির তেল বের করে ব্যবসা করছেন। আমাদের চার পুরুষের ব্যবসা এই ঘানি শিল্প। আমার দাদা ও নানাও এই ব্যবসা করতেন। এরপর আমার বাবা খুদু শেখ মারা যাওয়ার পর আমরা চার ভাই এই ঘানি শুরু করি। ব্যবসায় তেমন লাভ না হওয়ায় তিন ভাই এ পেশা বাদ দিই।

jagonews24

ফকিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগের মতো গ্রামে ঘানি আর চোখে পড়ে না। খাঁটি সরিষার তেলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমার বাবা, মা ও ভাই কানাডায় থাকেন। দুই মাস পর পর সেখানে খাঁটি সরিষার তেল পাঠাই।

হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি অফিসার সুমন মিয়া বলেন, বাজারের সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা এখন সরিষা চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছেন। এমনকি অনেক কৃষক নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত সরিষা মেশিনে নিয়ে তেল উৎপাদন করে ব্যবহার করছেন। যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ঘানি শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, জেলাজুড়ে কৃষকদেরকে বেশি করে সরিষা চাষাবাদের জন্য বলা হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে সরিষার বীজ কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।