বেনাপোল কাস্টমসের লকারকাণ্ড

৪ বছরেও অধরা ১৯ কেজি সোনা লুটের রহস্য

জামাল হোসেন
জামাল হোসেন জামাল হোসেন , উপজেলা প্রতিনিধি, বেনাপোল (যশোর)
প্রকাশিত: ০৫:৪৫ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

যশোরের বেনাপোল কাস্টমসের লকার থেকে ১৯ কেজি সোনা চুরির ঘটনার চার বছর হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি সোনা। হদিসও মেলেনি লকারের দুটি চাবির। এ ঘটনায় করা মামলা কেবল সাক্ষ্যগ্রহণেই থমকে আছে। সাক্ষীরা নির্ধারিত সময়ে আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় বিচারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

জানা যায়, কাস্টমস হাউসের পুরোনো দোতলা ভবনের যে কক্ষটিতে লোহার ভল্ট রাখা ছিল সেটি অনেক বেশি সুরক্ষিত। বাইরের যে কেউ এখান থেকে চুরি করে পালাতে পারবে না। সোনা চুরি হওয়ার স্থান থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারির প্রধান গেটটি মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে। সোনা চুরি হওয়ার বিষয়টি প্রথম থেকেই রহস্যজনক। হাউজের বাইরে থেকে চোর এসে চুরি করলে বাকি ৭৫টি সোনার বার এবং নগদ ৩ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা কেন ফেলে যাবে এ প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের।

তবে মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি বলছে, লকারের দায়িত্বে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও বহিরাগতদের দিয়ে লকার দেখভাল করায় এই চুরি সংঘটিত হয়েছে। আসামিরা চুরি করা সোনা বিক্রি করে ফেলায় সোনা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পাঁচ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ সাতজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

বেনাপোল কাস্টম ও সিআইডির অভিযোগপত্রের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর টানা তিন দিন ঈদে মিলাদুন্নবীর সরকারি ছুটি ও ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে কাস্টমস বন্ধ থাকার সুযোগে পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলার গোডাউনের তালা ভেঙে চোররা ভেতরে যায়। পরে তারা ভল্টের তালা ভেঙে ১৯ কেজি ৩১৮ দশমিক তিন গ্রাম সোনার বার চুরি করে। ওই সময়ে এর মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ভল্টের চাবি ছিল তৎকালীন ভল্ট ইনচার্জ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুলের কাছে।

গোডাউনের অন্য লকারে সোনা, ডলারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র থাকলেও সেগুলো চুরি হয়নি। ভল্ট ভাঙার সময় কাস্টমস হাউসের সবগুলো সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। ১২ নভেম্বর সকালে বিষয়টি জানাজানি হলে কাস্টমস হাউজের রাজস্ব কর্মকর্তা এমদাদুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে চুরির মামলা করেন বেনাপোল পোর্ট থানায়।

jagonews24

ভল্ট ইনচার্জ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুলকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর মামলাটি অগ্রগতির জন্য তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। দেড় বছরেরও বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ১৪ জুন ৫ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ সাতজনকে আটক দেখিয়ে চার্জশিট দেন সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম।

এতে বলা হয়, লুটে নেওয়া সোনার বার আসামিরা বিক্রি করে ফেলায় উদ্ধার সম্ভব হয়নি। বর্তমানে আসামিরা সবাই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন- খুলনার বটিয়াঘাটার জয়পুর গ্রামের রণজিৎ কুন্ডুর ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ বিশ্বনাথ কুন্ডু, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বাঁধুলি খালপাড়া গ্রামের মৃত জালাল সরদারের ছেলে কাস্টমস হাউজের সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুল সরদার, বরিশালের আগৈলঝাড়ার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের মৃত আব্দুর রবের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম মৃধা, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের অম্বিকাপুর গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ আরশাদ হোসাইন, খুলনার তেরখাদার বারাসাত গ্রামের মৃত আতিয়ার রহমান মল্লিকের ছেলে বেনাপোল কাস্টমসের এনজিও কর্মী আজিবার রহমান মল্লিক, বেনাপোলের ভবের পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল শেখের ছেলে শাকিল শেখ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার চারুয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ মোহাম্মদ অলিউল্লাহ।

আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে যশোর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ কত তারিখে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ দিন ধার্য ছিল ও ওই মামলাটি শেষ করতে আর কত দিন লাগবে তাও জানেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

মামলায় কাস্টমস কর্মকর্তা, আনসার সদস্য ও পুলিশ সদস্যসহ ৩৪ জন সাক্ষী আছেন। এরমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১০ জন।

যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রিস আলী জাগো নিউজকে বলেন, আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণেই এ মামলার কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ আছে। দ্রুতই বাকিদের সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্যে দিয়ে মামলাটি শেষ হবে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যশোর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আহম্মেদ বলেন, সাত আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ চুরির সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলা বিচারাধীন। তবে সোনা উদ্ধার ও লকারের আরও দুটি চাবি উদ্ধার সম্ভব হয়নি।

বেনাপোলের সাধারণ ব্যবসায়ী আনিছুর রহমান বলেন, এতগুলো সোনা খেয়ে ফেলার জিনিস না। সোনার বার বা সোনা বিক্রির টাকা এতদিনে কোনটাই উদ্ধার হলো না? আসামিরা আটক হলেও সবাই জামিনে। আমাদের দেশের প্রশাসন এখন অনেক দক্ষ। আরও আন্তরিক হলে চুরি হওয়া সোনার বার বিক্রি হলেও তার টাকা উদ্ধার কঠিন কিছু না।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেকপোস্ট আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বিপুল বলেন, কাস্টমস লকার থেকে সোনা চুরির ঘটনা ৪ বছর পার হতে গেলো। অথচ তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে সোনা উদ্ধার না হওয়ায় আমরা হতাশ। বেনাপোল কাস্টমস হাউস থেকে সোনা চুরি করে চক্রটি অনেকটা পার পেয়ে যাওয়ায় এবার ঢাকা বিমান বন্দরে সোনা চুরিতে অপরাধীদের সাহস যুগিয়েছে। যদি বেনাপোল কাস্টমস থেকে লুট হওয়া সোনা উদ্ধার হতো তবে হয়তো আবারো নতুন করে সরকারের এ সম্পদ লুটের কথা শুনতে হতো না।

স্বর্ণ চুরি মামলার প্রধান আসামি রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুল ইসলাম বলেন, আমি পূর্ববর্তী কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের কাছ থেকে ফাইল কেবিনে থাকা সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা বুঝে পেয়েছিলাম। তবে আমাকে ফাইল কেবিনের একটি মাত্র চাবি দেওয়া হয়েছিল। বাকি চাবিগুলো পূর্বের কর্মকর্তা দেননি। এ চুরির সঙ্গে আমি জড়িত না। যদি আরও ভালোভাবে তদন্ত করা হয়। তবে প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়বে ও সোনা উদ্ধার হবে। দোষী না হয়েও আমি চাকরিচ্যুত।

এসজে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।