মিরসরাইয়ে প্রাথমিকে পাঁচ বছরে কমেছে ৮ হাজার শিক্ষার্থী
# নূরানী মাদরাসা ও কেজিস্কুল নির্ভর হচ্ছেন অভিভাবকরা
# পাঁচ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয় বেড়েছে ছয়টি
# মোট শিক্ষার্থী আছে ৩২ হাজার
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিন দিন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমছে। সরকারি বিভিন্ন সুবিধা থাকার পরও বিগত পাঁচ বছরে উপজেলায় শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৮ হাজার। গ্রামে গ্রামে নূরানী মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেন বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এখন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে প্রাথমিকে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কমার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় পাঁচ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১৮৫টি। তখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। পাঁচ বছর পরে ছয়টি বিদ্যালয় বেড়ে হয়েছে ১৯১টি। কিন্তু বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও কমে গেছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। বর্তমানে ১৯১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে ৩২ হাজার। তাদের পাঠদানে আছেন ১ হাজার ১৮৫ জন শিক্ষক।
সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী আছে করেরহাট ইউনিয়নে অবস্থিত দৌলতবিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয়ে আছে মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। ২০২০ সালে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩৯ হাজার ৯৮০ জন। কিন্তু ২০২১ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ২৮৭ জনে। ওই বছর কমেছে ৩ হাজার ৬৯৩ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া ২০২১-২০২২ শিক্ষা বর্ষেও কমেছে অনেক শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩৬ হাজার ২৮৭ জন। ২০২২ সালে ৩ হাজার ৫২২ জন শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৭৬৫ জনে।
এদিকে ১ হাজার ১৮৫ জন শিক্ষক মাসে বেতন বাবদ উত্তোলন করেন ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া উপবৃত্তি পায় ২৭ হাজার পরিবার। হিসেবমতে সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে প্রতি মাসে সরকারের খরচ হয় প্রায় ১৩০০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাইয়ে আছে ৬০টি কিন্ডারগার্টেন। এসব স্কুলে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী আছে। মান ভেদে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী প্রতি মাসিক বেতন নেয়া হয় ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। এসব স্কুলগুলোতে পাঠদানে কোন প্রকার অবহেলা কিংবা ছাড় দেওয়া হয় না বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক। তাদের দাবি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা কেজি স্কুলগুলোতে দেওয়া হয় না। এছাড়া কেজি স্কুলে পাঠদানে কোনো প্রকার ফাঁকি দেন না শিক্ষকরা। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কেজি স্কুলের মতো দায়িত্ব নিয়ে পাঠদান করানো হয় না। অথচ কেজি স্কুলের চেয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন ভাতা বেশি।
মিরসরাইয়ের সাহেরখালী ইউনিয়নের ডোমখালী এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি করোনাকালের প্রভাব। সরকার যখন প্রায় দুবছর প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রেখেছিল, তখন নূরানী মাদরাসায় পাঠদান চলত। অনেক অভিভাবক তখন ছেলে-মেয়েদের নূরানী মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন।
উপজেলার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, আমাদের বিদ্যালয়েও প্রাইমারিতে ছাত্র-ছাত্রী অনেক কমে গেছে। নার্সারি ওয়ান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী তুলনামূলক অনেক কম। তিনিও এর জন্য নূরানী মাদরাসাকে দায়ী করেছেন।
এ বিষয়ে মিরসরাই কবির মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কিছুটা কমে গেছে এটা ঠিক। তবে পড়াশোনা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। স্কুলে না পড়ে অনেকে নূরানী মাদরাসায় পড়ছে। আর প্রাথমিকে ঝরে পড়ার বিষয়টি বললে, তা একেবারে নগণ্য। হয়তো দুই শতাংশ হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি ডা. জামশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ নূরানী মাদরাসা। গত কয়েক বছরে মিরসরাইয়ের গ্রামে অসংখ্য নূরানী মাদরাসা গড়ে উঠেছে। তাই অভিভাবকরা মাদরাসা নির্ভর হয়ে পড়ছে। এসব নূরানী মাদরাসা নিয়ন্ত্রণ কিংবা তদারকিতে নেই কোনো উদ্যোগ।
মিরসরাই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, অভিভাবকরা এখন মাদরাসা ও কেজি স্কুলমুখী হয়ে পড়ছে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে আমরা শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এ বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে একাধিক সভা করেছি।
এ বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মিরসরাইয়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ৮ থেকে ১০টি নূরানী মাদরাসা রয়েছে। একারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আশঙ্কাজনক ছাত্র-ছাত্রী কমে যাচ্ছে। অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানে পাঁচ ক্লাস মিলে শিক্ষার্থী আছে ৪০-৫০ জন। আমি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা সমন্বয় সভায় একাধিকবার বলেছি। শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করেছি। এলাকায় গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে, বুঝাতে হবে বাচ্চাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য। আমি মনে করি মূলত গ্রামে গঞ্জে নূরানী মাদরাসা বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব ফেলছে প্রাইমারি স্কুলের ওপর।
এসজে/জেআইএম