ইউপি সদস্যের ভাতা যায় দানে, অটোরিকশায় চলে সংসার
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বাসিন্দা রায়হান ব্যাপারী (৪২) ও নূরে আলম শিকদার (৪০)। পেশায় দুজনই অটোরিকশাচালক। তবে এ পেশার বাইরেও আরেকটি পরিচয় বহন করে আসছেন তারা। এলাকার জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন দুজনই। এদের মধ্যে রায়হান ব্যাপারী উপজেলার দারুল আমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ড আর নূরে আলম শিকদার একই ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য।
দুজনই অটোরিকশা চালানোর সময় অসহায় মানুষের দুঃখের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জনপ্রতিনিধি হবেন। নির্বাচিত হয়ে তাদের ওয়ার্ডের মানুষের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেবেন। নির্বাচিত হয়ে কথা রেখেছেন তারা, তবে বাদ দেননি অটোরিকশা চালানো। এ অটোরিকশার চাকায় ঘোরে তাদের সংসার। খবর পেলেই মানুষের সুখ দুঃখে ছুটে যান তাদের বাহন নিয়েই।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডামুড্যা উপজেলার দারুল আমান ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রায়হান ব্যাপারী। তিনি নান্দ্রা এলাকার মৃত আব্দুল মান্নান ব্যাপারী ও মৃত তানু বেগম দম্পতির ছেলে। একটা সময় ঢাকায় ছোট একটি চাকরি করলেও ১০ বছর আগে এলাকায় এসে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন তিনি। গত বছরের ইউপি নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। এরপরও এখন পর্যন্ত পেশা হিসেবে অটোরিকশা চালানোকেই ধরে রেখেছেন তিনি।
এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তার সম্মানী ভাতা ৩ হাজার ৬০০ টাকা ছয়টি মসজিদে দান করেন। অটোরিকশা চালানোর আয় দিয়েই চালিয়ে আসছেন সংসার। তার পরিবারে স্ত্রী শ্রাবনী আক্তার, রিয়া ও প্রিয়া নামের দুই কন্যা সন্তান আছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুর রব চৌকিদার বলেন, আমাগো মেম্বার অনেক ভালো মানুষ। আমাগো গরিবগো কষ্ট বুঝে। আমরা যখনই তারে ডাকি হে আমাগোর সমস্যার কথা শুনে। কখনোই শুনি নাই আমাগো এলাকার কোনো লোক তারে কাছে হয়রানির শিকার হইছে।
শফিকুল ইসলাম নামে একই ওয়ার্ডের আরেক বাসিন্দা বলেন, উনি করোনার সময় সাধারণ মানুষের জন্য যেভাবে এগিয়ে এসেছেন তাই আমরাই তাকে মেম্বার বানাইছি। রায়হান ভাই মেম্বার হলে কী হবে, তিনি আমাদের কাছে এখনো সেই আগের মতো সাধারণ একজন অটোরিকশাচালকের মতোই। কোথাও যেতে দেখলে তার অটোরিকশায় নিয়ে যায়। ভাড়া দিলে নেন, না দিলে নেন না। তিনি জনপ্রতিনিধি হয়েও এই অটোরিকশা চালিয়েই তার সংসার চালান।
ইউপি সদস্য রায়হান ব্যাপারী জাগো নিউজকে বলেন, এলাকার জনগণ আমাকে ভালোবেসে এই জায়গায় বসিয়েছেন। তারা আমাকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই জয়যুক্ত করেছেন। একজন জনপ্রতিনিধি চাইলে সৎভাবে তাদের জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। যেটা আমি প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিলাম এবং আমি সেটা প্রমাণ করেছি। তাই আমিও নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিনা স্বার্থে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এবং আগামীতেও তাদের জন্য কাজ করে যেতে চাই।
তিনি আরও বলেন, অটোরিকশা চালাতে গিয়ে মানুষের কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিগত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ওয়ার্ডের অসহায় মানুষদের হক থেকে বঞ্চিত করেছেন। সরকারি সাহায্য সঠিকভাবে বণ্টন করেননি। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের হক তাদের হাতে তুলে দেবো। এরপর মহামারি করোনার সময়ে অটোরিকশা চালানোর জমানো টাকা দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগেই ৬৩ জন অসহায় মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেন।
এ জনপ্রতিনিধি বলেন, গত বছর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা জানালে এলাকার লোকজনই আমার নির্বাচনী ব্যানার পোস্টার করে দেন। এমনকি ওই ওয়ার্ডের রিকশা-অটোরিকশা চালকরা যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি আমার হয়ে জনসংযোগ চালান। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ দেখেই ভোটাররা আমাকে বিপুল পরিমাণে ভোটে জয়ী করেন।
এদিকে পূর্ব ডামুড্যা এলাকা ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নূরে আলম শিকদার অটোরিকশা চালানোর সময় এলাকার দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। অটোরিকশায় যাওয়া-আসার সময় এসব মানুষের কাছ থেকে তাদের সুখ দুঃখের গল্প শুনতেন। তারা অভিযোগ করে বলতেন, অনেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না। এমনকি তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এসব কথা শুনে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা জাগে তার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন নির্বাচনে জয়লাভ করলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। এরপর গত নির্বাচনে তিনি অংশ নিলে এলাকার মানুষ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। তবে ইউপি সদস্য হওয়ার পরেও এখনো জীবিকা নির্বাহ করেন অটোরিকশা চালিয়েই।
৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রোমান খান বলেন, নূরে আলম শিকদার আমাদের ভাইয়ের মতো। আমরা তার কাছে সব ব্যাপারে জানাই। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে মেম্বারকে মধ্যরাতে তার অটোরিকশার জন্য ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। একজন মেম্বার হয়েও কখনোই তার মধ্যে অহংকার দেখিনি।
সুমন খাঁন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, তার ভালো ব্যবহারের কারণেই তাকে আমরা আমাদের জনপ্রতিনিধি বানিয়েছি। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রকৃত অসহায় মানুষ তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে পাচ্ছেন। তিনি নিজ দায়িত্বে অটোরিকশা চালিয়ে অসহায় মানুষের পাশে ছুটে যান।
ইউপি সদস্য নূরে আলম শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমি যখন মেম্বার হওয়ার কথা এলাকার লোকদের জানাই তারাই ভোটে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেন। আমি প্রার্থী হলে তারা বিপুল ভোটে জয়ী করেন। তাদের ভালোবাসার কারণেই আজ আমি সেবা করতে পারছি। বিপদে আপদে তাদের ডাক পেলেই ছুটে যাই। জনগণ যতদিন চাইবেন আমি তাদের সেবা দিয়ে যেতে চাই।
তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে দারুল আমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মমিনুল হক মিন্টু শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ অর্থের দিক দিয়ে গরীব হলেও মানসিক দিক থেকে সচ্ছল আর সবল থাকলে সাধারণ মানুষের দিকটা বেশি ভাবেন। যেটা আমার দুই মেম্বার রায়হান ব্যাপারী ও নূরে আলম শিকদারের মধ্যে আছে। তারা দুজনই মেহনতী মানুষ, তাই গরীব মানুষের কষ্টটাও তারা বেশি উপলব্ধি করতে পারেন। জন সাধারণের সেবা দেওয়ার জন্য এমন মানসিকতার মানুষই আমাদের বেশি প্রয়োজন।
এসজে/জেআইএম