বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভোগান্তিতে ৮ গ্রামের মানুষ
ব্রিজ কিংবা স্লুইসগেট না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ নির্মাণ করায় ভেঙে পড়ছে আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনা। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় প্রায় ৫০০ বিঘা আবাদি জমিতে বালু জমতে শুরু করেছে। এতে তিন শতাধিক কৃষকসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে আটটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। সম্প্রতি জামালপুর ঘেঁষা সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের যমুনার শাখা নদীতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের স্বার্থে এ বাঁধ নির্মাণ করেছেন। এতে কিছু বাড়িঘর রক্ষা হলেও বিপদে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
কাজিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের গুজাবাড়ি এলাকার সম্মুখভাগে যমুনার শাখা নদীতে ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এরইমধ্যে কাজের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি পশ্চিমদিকে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: নদীভাঙন রোধের ব্লক নিজ বাড়িতে নিলেন পাউবোর প্রকৌশলী
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কাজিপুরের ১৩টি গ্রাম নিয়ে চরগিরিশ ইউনিয়ন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সবে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে এ অঞ্চলে। প্রতিটি ঘর এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শত বছরের পুরোনো যমুনার শাখা নদী। আর এই নদীর গুজাবাড়ি গ্রামের সম্মুখভাগে (পূর্ব-পশ্চিমে আড়াআড়িভাবে) অপরিকল্পিতভাবে আনুমানিক ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁধ নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এ বাঁধের ফলে এরইমধ্যে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ভোলারদিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বইতে শুরু করেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে ছালাল, সিন্দুর আটা, ভোলারদিয়া, রঘুনাথপুর, রাজনাথপুর, জোরবাড়ি, গুয়াখড়া (পশ্চিম অংশ) ও গুজাবাড়ি (উত্তরের কিছু অংশ) গ্রামের ২০ হাজার মানুষ। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে প্রায় ৫০০ বিঘা আবাদি জমিতে বালু জমতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে দুইটি ব্রিজ, একটি পাকা ও একটি কাঁচা রাস্তা ভেঙে গেছে। অপরদিকে, বাঁধের দক্ষিণে দিনদিন শুকিয়ে চর পড়ে যাচ্ছে। এছাড়া এই বাঁধের কারণে নদীর নাব্যতা হারিয়ে যমুনা সার কারখানার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চরগিরিশ ইউনিয়নের ভোলারদিয়া গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষক কালু চাকলাদার জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধের কারণে আমার ১১ বিঘা জমিতে বালু জমেছে। আর কোনোকিছু চাষ করতে পারছি না। আমরা কৃষক মানুষ, মাঠে ফসল ফলিয়েই সংসার চালাই। এখন কী করবো বুঝতে পারছি না। আমরা এ বিষয়ে কিছু বললেই অত্যাচার করে। এজন্য কেউ কিছু বলার সাহসও পায় না।
স্থানীয় কৃষক জুড়ান, আব্দুল মমিন ও রিপন শেখসহ আরও কয়েকজন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা জন্মের পর থেকেই এ অঞ্চলে বসবাস করি। কিন্তু এই বাঁধ করার আগে এমন পানির স্রোত এখানে দেখিনি। এ বাঁধের কারণে শুধু ফসলি জমি নয়, ৮ থেকে ১০ গ্রামের মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় কিছু সরকারদলীয় নেতারা জনপ্রতিনিধিদের ভুল বুঝিয়ে এই বাঁধটি করেছেন। এখন লাভের চেয়ে আমাদের ক্ষতিই বেশি। এটি মূলত নেতাদের আত্মীয়-স্বজনের কয়েকটি বসতভিটা বাঁচাতে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাদের সিদ্ধান্তে বাঁধ হওয়ায় এখন এলাকার যাতায়াতের রাস্তা ভেঙে পড়ছে। হুমকিতে রয়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি। বিষয়টি স্থানীয় নেতাদের জানানোর পর ভেঙে যাওয়া রাস্তায় কিছু বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করলেও কাজে আসছে না।
আরও পড়ুন: হাতিয়ায় স্থানীয়দের অর্থায়নে হচ্ছে নদীভাঙন রোধের কাজ
তারা আরও দাবি করেন, আমরা গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এজন্য এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত যেতে পারি না। যে কারণে তারা আমাদের দুঃখের কথা জানতেও পারেন না। কিন্তু এলাকার নেতারা এমপি ও উপজেলা পরিষদকে বুঝিয়ে এ বাঁধ নির্মাণ করেছেন। আমরা দ্রুত এই বাঁধের অপসারণ চাই।
একই দাবি করে হৃদয় মিয়া নামে এক স্থানীয় শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, দক্ষিণের ওই বাঁধের কারণে বাড়িঘর, কাঁচা-পাকা রাস্তা, ব্রিজ ও ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। স্থানীয় কয়েকজন নেতার প্ররোচনায় এই অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এ কারণে কিছু লোকের উপকার হলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েকগুণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তাই যত দ্রুত সম্ভব বাঁধটি অপসারণ করা হোক। এতে ৫০০ বিঘা ফসলি জমিসহ রক্ষা পাবে প্রায় ২০ হাজার মানুষ।
চরগিরিশ ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ঠান্ডু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় ব্রিজ ও যাতায়াতের রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। এতে সবার দুর্ভোগ ও ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
একই ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য মোছা. ছাবিনা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, এ বাঁধের কারণে আমারও কিছু জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ ভেঙে গেছে। হুমকির মুখে বসতবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ বিষয়ে তিনি দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদে আলোচনা করবেন বলে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক দীপক কুমার জাগো নিউজকে বলেন, নদীর পানি চলার পথে বাধা পেলেই সে গতিপথ পরিবর্তন করে ঢালু পথ খুঁজে নেয়। এজন্য নদীতে কোনো বাঁধ নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই পানির প্রবাহ ঠিক রেখে নির্মাণ করতে হবে। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিতে হবে। কেননা যে কোনো পরিকল্পনা সঠিক না হলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে।
বাঁধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চরগিরিশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধের কারণে নদী ভরাট হয়ে ওইসব এলাকার মানুষের উপকার হচ্ছে। তবে কিভাবে উপকার হচ্ছে জানতে চাইলে সে প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি দেননি।
আর ওই বাঁধের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁধের কারণে নদীর গতিপথে কোনো প্রভাব পড়েনি। ভেতরের খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ৫০০ বিঘা ফসলি জমিতে বালু জমার কথা বললে বিষয়টি এড়িয়ে যান চেয়ারম্যান।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নে আমাদের কোনো প্রকল্পের বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে না। তবে উপজেলার কোনো একটা প্রকল্পের মাধ্যমে ওই বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে বলে জেনেছি।
কাজিপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান সিরাজী জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে। কাজের কিছু অংশ এখনো বাকি আছে মনে হয়। তবে এ বাঁধের কারণে ফসলি জমিতে বালু জমাট ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে কি না তা তার জানা নেই।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মশকর আলী জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো ফসলি জমিতে বালু জমলে চাষাবাদ হবে না। ফলে শস্য উৎপাদন কমে যাবে। এ বিষয়ে সরেজমিন গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: চাঁদা না পেয়ে নদীভাঙন রোধ প্রকল্পের সুপারভাইজারকে মারধর
এ প্রসঙ্গে কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার জাগো নিউজকে বলেন, চরগিরিশ ইউনিয়ন একটি নদীভাঙন কবলিত এলাকা। ভাঙন রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। তবে ওই বাঁধের বিষয়ে আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দিতে অবস্থিত যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, বাঁধটির কারণে দিনদিন নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। এতে সার উৎপাদনে বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সম্প্রতি বাঁধটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি। তবে কে বা কারা এই বাঁধটি নির্মাণ করেছে তা আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে গত ৩০ আগস্ট বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে নদী রক্ষা কমিশনে ই-মেইল করা হয়। উত্তর না পেয়ে ৩১ আগস্ট দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখনো ই-মেইল দেখার সুযোগ হয়নি। তাই তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে ই-মেইল পাঠিয়ে থাকলে তিনি দেখে তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন।
এমএ মালেক/মো. নাসিম উদ্দিন/এমআরআর/জেআইএম