জনবল সংকটে নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তি
নারায়ণগঞ্জ জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে নানা ধরনের পোস্টারের। এর মধ্যে রয়েছে ‘দালাল হতে সাবধান; ওরা প্রতারক ও ভণ্ড ওদের ধরিয়ে দিন’, ‘নিজের পাসপোর্ট আবেদন নিজে করি; দালালমুক্ত দেশ গড়ি’, ‘সঠিক ঠিকানা অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের আবেদন করুন’সহ নানা নির্দেশনা। পুরো পাসপোর্ট ভবনজুড়েই এসব নির্দেশনা সম্বলিত পোস্টার সাঁটানো রয়েছে।
সেইসঙ্গে অফিস ভবনের প্রত্যেক তলায় ও সিঁড়িতে কোন কর্মকর্তা কোথায় বসেন সে নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া নিচতলাতেই কোন কাজের জন্য কোথায় যেতে হবে তা উল্লেখ করে বড় করে বোর্ড লাগানো হয়েছে। আর এভাবেই পাসপোর্ট আবেদনকারীদের পরিপূর্ণ সেবা দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অফিসকে দালালমুক্ত রাখতে প্রবেশেও রয়েছে কড়াকড়ি। নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া ভেতরে প্রবেশে রয়েছে মানা। তারপরেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেন থেকেই যাচ্ছে। পাসপোর্ট আবেদনকারীরা নিজেদের ঝামেলামুক্ত রাখার জন্য সেই দালালের স্মরণাপন্নই হচ্ছেন। ভেতরে প্রবেশে কড়াকড়ি থাকলেও ছলে বলে কৌশলে দালালরাও প্রবেশ করছেন। সেইসঙ্গে নির্ধারিত ফির পাশাপাশি বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের।
এছাড়া নিজে সরাসরি আবেদন করতে গেলে তাতেও দীর্ঘসময় ব্যয় করতে হচ্ছে। বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে, যা অনেকের কাছেই ভোগান্তির কারণ মনে হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে ১০ বছর মেয়াদে ৬৪ পৃষ্ঠার জন্য ব্যাংক জমা ৮ হাজার ৫০ টাকা। আর জরুরি ভিত্তিতে করলে তা ১০ হাজার ৩৫০ টাকা। একই সংখ্যক পাতায় পাঁচ বছরের জন্য ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। আর জরুরি ভিত্তিতে করলে জমা দিতে হয় ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। এছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টে ১০ বছরের জন্য ৫ হাজার ৭৫০, আর জরুরি করলে ৮ হাজার ৫০ টাকা জমা দিতে হয়। তবে পাঁচ বছরের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা। আর জরুরি ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। সেখানে দালালদের দিতে হয় ৪৮ পৃষ্ঠার সাধারণ বইয়ের জন্য ১০ হাজার ও জরুরির জন্য দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। আর ৬৪ পৃষ্ঠা বইয়ের জন্য ১৫ হাজার টাকার মতো গুনতে হয়।
পাসপোর্ট অফিসের আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। আবেদন ফরম পূরণ করার জন্য এসব দোকানে গেলেই সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা দালালরা নানা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে থাকেন। এসময় পাসপোর্ট আবেদনকারীরাও তাদের প্রলোভনে পড়ে যাচ্ছেন। তবে যারা সরাসরি অফিসে যোগাযোগ করছেন তারা দালালের খপ্পরমুক্ত থাকতে পারছেন।
শহরের সরকারি তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী তামিম উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য কানাডা যাবেন। তিনি বলেন, প্রথমদিন এসেই আবেদন করে টাকা জমা দিয়েছি। আপাতত তেমন কোনো ভোগান্তির শিকার হতে হয়নি। দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়। তবে আশা করছি, সবকিছু ঠিক থাকলে কোনো রকম ভোগান্তির শিকার হতে হবে না।
শহরের গলাচিপা এলাকার বাসিন্দা নজরুল স্ত্রীসহ কিছুদিনের মধ্যেই ওমরা পালন করতে যাবেন। তাই তিনি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) থেকে ই-পাসপোর্ট করবেন। কিন্তু এমআরপি পাসপোর্ট করার সময় তার জন্ম সালে সংখ্যাগত ভুল ছিল। নতুন করে ই-পাসপোর্ট করতে গিয়ে তিনি পড়েছেন মহাবিপাকে।
নজরুল ইসলাম বলেন, গত একমাস ধরেই পাসপোর্ট অফিসে প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। এক জায়গায় গেলে সেখান থেকে অন্য জায়গায় পাঠায়। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। জানি না কবে এই সমস্যার সমাধান হবে।
শহরের দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা নাবিল হোসেন বলেন, আমার বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করার দরকার ছিল। দালালের কাছে দিয়ে দিছি। তারাই আমাকে সবকিছু করে দিয়েছে। নিজে করতে গেলে অনেক ঝামেলা আর ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই কোনো ভোগান্তিতে না গিয়ে দালালের কাছে দিয়ে দিছি। এজন্য আমাকে বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
পাসপোর্ট অফিস সূত্র বলছে, প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ শতাধিক পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। তাদের জনবলের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। যে কারণে আবেদনকারীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রতিদিনই দীর্ঘ লাইন থাকে।
নতুন জনবল নিয়োগ করলে আবেদনকারীদের ভোগান্তি কমে আসবে। সেইসঙ্গে অফিসের ভেতরের জায়গা অনেক ছোট। যে কারণে আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তাদের জায়গার সংকুলান হয় না। রোদের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়েই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. রুকুনুজ্জামান ভূঞা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সেবা দেওয়ার জন্য। তবে প্রয়োজন অনুসারে জনবল থাকলে হয়তো সেবা প্রদানে কোনো ঘাটতি থাকতো না। তাছাড়া আমাদের এখানে জায়গাটা ছোট হয়ে গেছে। যার কারণে অনেক সময় আবেদনকারীদের রোদ-বৃষ্টিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। যা আমাদের কাছে খারাপ লাগে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এসব সমস্যার সমাধানের জন্য।
তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট করতে গিয়ে কোনো ভুল হয়ে থাকলে যেগুলো আমাদের এখানে সংশোধনের সুযোগ থাকে আমরা করে দিই। আর যদি আমাদের এখানে সুযোগ না থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলি। সেইসঙ্গে দালালরা আতঙ্ক ছড়িয়ে সেবাগ্রহীদের তাদের কাছে নিয়ে যায়। এজন্য আমরা অফিসের বাইরে কারও সঙ্গে কথা না বলার জন্য বলি।
জেলা অফিসের উপ-পরিচালক গাজী মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সেবাগ্রহীতাদের পরিপূর্ণ সেবা দেওয়ার জন্য। তবে অনেক সময় জনবল সংকটের কারণে সেবাগ্রহীতাদের কিছুটা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সেইসঙ্গে আমাদের অফিস দালালমুক্ত। দালালদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। দালাল থাকলে বাইরে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সবাইকে বলবো, আবেদনকারীকে নিজে এসে আবেদন করার জন্য। আর যদি আবেদন করতে গিয়ে কোনো ভুল হয় সেটা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্য অফিসিয়াল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
এমআরআর/এমএস