দেশসেরা সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ হয় নোংরা পানিতে

এসকে রাসেল
এসকে রাসেল এসকে রাসেল , জেলা প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩

কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে সাঁতারে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এসেছে সাফল্য। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উঠে এসেছেন কারার মিজান ও কারার ছামেদুলের মতো দেশসেরা সাঁতারুরা। দেশের হয়ে তারা স্বর্ণ জয় করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।

তারপরেও নিকলীতে গড়ে ওঠেনি সাঁতার শেখার কোনো অবকাঠামো। দেশসেরা সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ হয় নোংরা পানিতে। এ অবস্থায় একটি সুইমিং পুল নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, নিকলী সদর ইউনিয়নের মীরহাটির আবুল কাশেমের ছেলে আবুল হাশিমই নিকলীর সাঁতারের অগ্রপুরুষ। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আন্তঃস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় এবং ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ২০টি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এর পরের গল্পটা আবুল হাশিমের ছাত্রদের। তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন।

নিকলী সদরের কারার বাড়ির কারার মিজানুর রহমানকে আবুল হাশিমই প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশসেরা সাঁতারু বানিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে কারার মিজানুর রহমান সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জিতে দেশের বিবর্ণ সাঁতারে আশার এক ক্ষীণ আলো জ্বালিয়েছিলেন। ১৯৮৫ সাল থেকে কারার মিজানুর রহমান বয়সভিত্তিক সাঁতারেও বহুবার স্বর্ণ জিতেছেন।
মিজানুর রহমানের চাচাতো ভাই কারার ছামেদুল ইসলামও সাঁতারে তার কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নেন। ২০০১ সাল পাকিস্তানে আয়োজিত সাফ গেমসে সুইমিংয়ে নিকলীর তরুণ সাঁতারু ছামেদুল জেতেন চারটি স্বর্ণপদক। তার আগে ১৯৯৯ সালে নেপালে আয়োজিত সাফ গেমসে জিতেছেন রৌপ্য পদক। ২০০২ সালে বাংলাদেশ গেমসে ১০০ মিটার সাঁতারে মিজানের গড়া (১ দশমিক ০৯ মিনিট) রেকর্ড ভেঙে ফেলেন ছামেদুল। তিনি সময় নিয়েছিলেন (১ দশমিক ০৭ মিনিট)। দেশের কিশোর-তরুণদের সামনে সেই উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছেন নিকলীর সাঁতারুরাই।

এই উপজেলারই আরও অন্তত ৭০ জন তরুণ এই সাঁতারেই আলো ছড়িয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। যার সুবাদেই চাকরি মিলছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে। তাদের মধ্যে অনেক নারীও আছেন। সাঁতারে নিকলীর তরুণদের খ্যাতির এই গল্প এখানেই শেষ নয়।

নিকলীর সাঁতারুদের আরেক বিস্ময় তরুণরে নাম আরিফুল ইসলাম। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বয়সভত্তিকি সাঁতারে ১৩টি ইভেন্টের সব কয়টিতেই স্বর্ণপদক জেতেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে তিনটিতে করেন জাতীয় রেকর্ড। আরিফুলের বড় ভাই শরিফুল ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারে পাঁচটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন পাঁচটি স্বর্ণপদক।

আবুল হাশিমের ছেলে নিয়ামুল হক ও নাজমুল হক। বর্তমানে সেনাসদস্য নিয়ামুল জুনিয়র জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত ৩৫টি সোনা জিতেছেন। আরেক ছেলে সেনাসদস্য নাজমুল হক ২০০৯ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদে ১৯ কিলোমিটার সাঁতারে দ্বিতীয় স্থান পান। ২০০৫ সালে জাতীয় সাঁতারে চারটি স্বর্ণ, ২০০৬ সালে তিনটি স্বর্ণ, ২০০৭ সালে চারটি স্বর্ণপদক পান।

এই নিকলীতে শুধু ছেলে সাঁতারুদের জন্ম হয়েছে এটা ভাবলে ভুল হব। এখানে সাঁতার কৃতিত্ব থেকে পিছিয়ে নেই নারীরাও। নিকলীর মেয়ে রুমানা আক্তার, প্রিয়াঙ্কা আক্তার ও নাসরিন বেগম সাঁতারে কৃতিত্ব দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। প্রিয়াঙ্কা আক্তার ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে একটি রৌপ্যপদক পান। আর রোমানা আক্তার একই সালে জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন ১১টি স্বর্ণপদক।

সর্বশেষ ২০২৩ সালের দ্বিতীয় যুব গেমসে ১৬ স্বর্ণ পদকের মধ্যে ১২টিই নিকলীর সাঁতারুরা পেয়েছে। এর মাধ্যমেই ঢাকা বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপরেও কোনো সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি তাদের। জেলা ক্রীড়া অফিসার সেখানে কোনো তদারকিও করেননি।

কারার মিজান সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পর ১৯৯৪ সালে আবুল হাশেম নিকলী সুইমিং ক্লাব গড়ে তুললেন। ভাটি বাংলা নামে আরেকটি সুইমিং ক্লাব ২০১১ সালে গড়ে ওঠে। দুটি ক্লাবই বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের অনুমোদন পেয়েছে। এ দুই ক্লাবের সদস্য ও প্রশিক্ষণার্থী তিন শতাধিক। তাদের মধ্যে অনেক নারীও রয়েছেন সাঁতারের শিক্ষার্থী। কারার মিজান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হয়েছেন এছাড়া আরিফুল হক ফ্রান্সে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভাটি বাংলা সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষণ চলে নিকলী উপজেলা পরিষদের ভেতরে একটি পুকুরে। পরিষদের ভেতরের আরেকটি পুকুরে চলে নিকলী সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষণ। দুই পুকুরেই চাষ হয় মাছের। পুকুরের পানি মুখে নেওয়ার মতোও না। এই পানিতেই চলে প্রশিক্ষণ। অনেক সময় এই নোংরা পানিতে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীরা।

নিকলীতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাতো দূরের কথা, ডাইভ দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। প্রশিক্ষণার্থীরা সুইমিং পোশাক, কিকবোর্ড, হ্যান্ড প্যাডেল, ওয়াটার গ্লাস, ওয়াটার ক্যাপ ছাড়াই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। অনেকে আছেন গামছা পরে।

সাঁতারের শিক্ষার্থী ইশা মনি বলেন, আমরা যে পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিই সেই পুকুরে পানি ভালো না। অনেক বাঁধা পেরিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসি। যদি নিকলীতে একটি সুইমিং পুল হতো তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো।

সাঁতারের শিক্ষার্থী তিথি দাস বলেন, এই পুকুরে সুইমিং করতে আমাদের অনেক সমস্যা হয় কারণ পানির অনেক ঘনত্ব। এছাড়া সাঁতারের আধুনিক কোনোকিছু আমাদের কাছে নেই। তাই প্রশিক্ষণ নিতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। তারপরেও চেষ্টা করে যাচ্ছি আন্তর্জাতিক মানের সাঁতারু হওয়ার।

আরেক সাঁতারু আকিব হোসেন বলেন, আমরা যে পুকুরে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিই সেখানে মাছের চাষ হয়। পুকুরে মাছের খাদ্য দেওয়ার কারণে পানি দূষিত হয়ে গেছে। এই পানির কারণে আমাদের চুলকানিসহ অনেক ধরনের রোগ হয়। সাউথ এশিয়ান গেমসে ভালো কিছু করার লক্ষ্য নিয়েই আমি প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।

নিকলী সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষক জুবায়ের আহমেদ বলেন, নিকলীর সাঁতারুদের মনোবল শক্ত। দেশের সাঁতারুদের ৫০ পারসেন্টই নিকলীর। তার পরেও নিকলীতে এখন পর্যন্ত সাঁতারের আধুনিক মানের কিছু নেই। নিকলীর সাঁতারুরা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার পরেও আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না।

ভাটি বাংলা ক্লাবের সাঁতার প্রশিক্ষক আবদুল জলিলের ভাষায়, সাঁতার জানলেই ভালো সাঁতারু হওয়া যায় না। নিয়ম মেনে অনুশীলন করতে হয়। সাঁতারে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করলেও নিকলীর সাঁতার প্রশিক্ষণ হয় সনাতন পদ্ধতিতে।

তিনি বলেন, আমাদের কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। এমনকি কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয় না। আমাদের দাবি, নিকলীতে একটি সুইমিং পুল করে দেওয়া হোক। সুইমিং পুল হলে এই নিকলীতে থেকে আরও ভালোমানের সাঁতারু তৈরি হবে বলে আশা করি।

কৃতি সাঁতারু কারার ছামেদুল বলেন, সাঁতারের জন্যই নিকলীর অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি। তা দেখে এলাকার অনেক তরুণ-কিশোররা সাঁতারে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

নিকলীর সাঁতারের জনক আবুল হাশিম বলেন, চারদিকে কত পানি, কিন্তু এত পানির প্রয়োজন আমার নেই। কেবল ৫০ মিটার একটা সুইমিং পুল দরকার। সুইমিং পুল পাওয়া গেলে নিকলী থেকে প্রতিবছর বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাঁতারু বের হবে।

জেলা ক্রীড়া অফিসার নূরে এলাহী বলেন, সরকার যদি নিকলীতে একটি সুইমিং পুল করে দিতো তাহলে এখানকার সাঁতারুরা আরও ভালো করতো। বিভিন্ন সময় জেলা ক্রীড়া অফিস চেষ্টা করে তাদের পাশে দাঁড়াতে।

এসকে রাসেল/এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।