খরচ বেড়েছে মেসের শিক্ষার্থীদের
খাবারের তালিকায় ভাজি-ডাল-শাকসবজি, বাদ পড়ছে ডিমও
‘বাজারে সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতি। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আলুভর্তা, ভাজি, পাতলা ডাল, শাকসবজি, এখন প্রতিদিনের খাবার। আগে খাবারের তালিকায় সপ্তাহে তিন দিন দুপুরে ডিম থাকলেও দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন শুধু পাতলা মসুর ডাল ও সবজি ভাজি খাওয়া হচ্ছে। আবার ডিম খেলেও অর্ধেক করে খাওয়া হয়। কম টাকায় কীভাবে মাস পার করা যায়, সবাই সেই চেষ্টা করা হয়।’
এভাবেই মেসের খাবার তালিকার কথা বলছিলেন নওগাঁ সরকারি কলেজের মাস্টার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী আল-আমিন। শুধু তিনিই নন, তার মতো মেসে থাকা অন্য শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় নওগাঁ সরকারি কলেজ। এছাড়া আছে সরকারি বিএমসি মহিলা কলেজ, আস্তানমোল্লা ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব কলেজকে কেন্দ্র করে আশপাশে প্রায় ২০০-২৫০টি মেস গড়ে উঠেছে। এসব মেসে প্রায় ১৬-১৮ হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকতে পারেন।
মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেকে আছেন যারা নিজেই নিজের খরচ চালিয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা টিউশনি করেন চলেন। কিন্তু আগে স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ টাকা খরচ হতো তা অনেক বেড়ে গেছে। বেতন না বাড়লেও কমেছে টিউশনির সংখ্যা। ফলে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেও তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর। প্রতিদিনের খাবারে তালিকায় করতে হচ্ছে কাটছাঁট। যেখানে ছয় মাস আগেও মেসে তিন বেলায় চালসহ খাবার বাবদ ৫০-৫৫ টাকা হলেই চলতো। এখন তিন বেলা খাবারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা। টাকা বাড়লেও কমেছে খাবারের মান ও পরিমাণ। এতে আমিষের ঘাটতি ও পুষ্টিহীনতার অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন হাজারো শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা মেসের জন্য প্রতিদিন বাজার করে থাকেন পৌরশহরের সিও অফিস বাজারে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এক হালি ফার্মের মুরগির ডিম কিনতে লাগছে ৫০ টাকা। এছাড়া হলেন্ডার (কার্ডিনাল) আলু, পটল, লাউ, ঢ্যাঁড়স এবং কাঁচা পেঁপে ছাড়া ৬০ টাকা কেজির নিচে মিলছে না কোনো সবজি।
মেসের শিক্ষার্থীদের কাছে সবজি ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করেন সাগর আলী। তিনি বলেন, এখন বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। এ জন্য মেসের শিক্ষার্থীরা আগের মতো আর সদাই কেনেন না। অনেক মেসের শিক্ষার্থীর কাছে মাসের ২০-২২ দিন যাওয়ার পর টাকা থাকে না। এসে বাকি চান। বাধ্য হয়ে বাকি দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ডিমের দামও বেশি হওয়ায় বেচাকেনাও কমে গেছে। ডিমও কিনতে চান না মেসের শিক্ষার্থীরা। এখন শুধু বিভিন্ন ধরনের সবজি কেনেন তারা।
নওগাঁ সরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বানী বলেন, বাজারে সব জিনিসের ঊর্ধ্বগতিতে মেসের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছি। মেসভাড়া, খাওয়া বাবদ ও বিদ্যুৎ বিলসহ সব খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আবার নিজের খরচও আছে। বাড়ি থেকে এত টাকা দিতেও চান না। তাই বাধ্য হয়ে এক মাস আগে থেকে একটি টিউশনি করাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আগে মাসে একদিন গরুর মাংস খাওয়া হতো। এখন তো মেসে গরুর মাংস খাওয়া ভুলেই গেছি। এছাড়া সপ্তাহে দুদিন ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও মাছ প্রায় খাওয়া হতো। কিন্তু বাজারে এখন সব জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে খাবারের তালিকা থেকে বাদ পড়ছে ব্রয়লার মুরগিও। সম্প্রতি ডিমের দাম বেড়ে যাওয়াতে ডিমও খাওয়া হচ্ছে না। মাছের দামও বৃদ্ধিতেও আগে দুপুরের খাবারে যে পরিমাণ মাছ খাওয়া হতো বর্তমানে সেখানেও অর্ধেক খাওয়া হচ্ছে। ধরতে গেলে আলুভর্তা, ভাজি, পাতলা ডাল, শাকসবজি এখন প্রতিদিনের খাবার।
মাস্টর্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, কোনো রকম টিউশনি করে পড়াশোনা ও মেসের খরচ চালাই। আগে টিউশনি করতাম ৩টা এখন ২টা। টিউশনির বেতন বাড়েনি বরং কমেছে টিউশনির সংখ্যা। বর্তমানে মেসে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
জোবায়ের হোসেন নামে মেসের দায়িত্বে থাকা (মনিটর) এক শিক্ষার্থী বলেন, এমনিতেই বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। ফলে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করলেও তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় করতে হচ্ছে কাটছাঁট। ১৫ দিন আগেও সপ্তাহে তিনদিন ডিম খাওয়া হতো। হঠাৎ ডিমের দাম বেড়ে যাওযায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এর বদলে ডাল ও ভাজি অথবা শাকসবজি খাওয়া হচ্ছে। তাও যদি খরচ একটু কম হয়। তবে খরচ কমাতে গিয়ে আমিষের ঘাটতি ও পুষ্টিহীনতার অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন আমাদের মতো শিক্ষার্থীরা।
নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. আবুহেনা মুহাম্মাদ রায়হানুজ্জামান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা মনে করি প্রোটিনের একমাত্র উৎস মাছ-মাংস। আসলে তা কিন্তু নয়। ডিম, ডাল, বিভিন্ন শাকসবজির মধ্যেও ভিটামিন আছে। আমরা এগুলো প্রচুর পরিমাণে খেতে পারি। বাজারে একটি ডিমের দাম ১৫। খুব বেশি নয়। প্রতিদিন একটি ডিম খাওয়া যেতে পারে। তবে এগুলো যে একমাত্র পুষ্টিকর খাবার সেটি কিন্তু নয়। আমাকে খুঁজতে হবে, কোথায় আমিষ আছে। কোথায় শর্করা আছে। তাহলে মনে করি আমিষের ঘাটতি ও পুষ্টিহীনতা অভাব দূর হবে।
এ বিষয়ে নওগাঁ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রুবেল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করি, যেন কোনো বিক্রেতা সিন্ডিকেট করে মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য না নেয়। কোনো অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বেশি রাখলে জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়া যদি কোনো ক্রেতা পণ্যর দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ করেন অবশ্যই আমরা ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবো।
এসজে/জেআইএম