সৌর বিদ্যুতে কাটছে তিস্তাপাড়ের অন্ধকার
অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া জনপদ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকে চরের জমি আর গ্রীষ্মে সাদা বালুর আস্তরণ। ঠিক তখনি উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার দ্বার। চরের সাড়ে ৬০০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় ও এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে চরাঞ্চলের মানুষের ঘটেছে জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন।
তিস্তা নদীর এপারে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ এবং পাশেই রংপুরের পীরগাছা আর ওপারে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা। এই তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী সংযোগস্থলে তারাপুর ইউনিয়নের লাটশালা ও চরখোর্দ্দা গ্রামের তিস্তা নদীর তীরে দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অবস্থান। তিস্তা সোলার লিমিটেড নামে এ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেড।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের দিকে নিজস্ব অর্থায়নে দুর্গম চরের তপ্ত বালু রাশির পরিত্যক্ত সাড়ে ৬০০ একর জায়গায় দেশের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে ৮৫টি মাউন্টিং পাইলস। যার ওপরে বসানো হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার সৌর প্যানেল।
আরও পড়ুন: দেশের সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
এসব সৌর প্যানেল থেকে ১২০টি ইনভার্টারের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এজন্য ২৮টি বক্স ট্রান্সমিশনে সংযোগ স্থাপন, সাবস্টেশনসহ ১৩২ কেভিএ ট্রান্সমিশন টাওয়ার নির্মাণ এবং জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তির জন্য তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে রংপুর পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে ১২২টি টাওয়ারের ৩৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার লম্বা সঞ্চালন লাইন। এ লাইনের মাধ্যমেই সুন্দরগঞ্জের তিস্তাপাড়ের কেন্দ্রটি থেকে রংপুর গ্রিড সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে উৎপাদিত বিদ্যুৎ। এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দৈনিক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৩.৯৩ টাকা চুক্তি মূল্যে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে রংপুরে বিভাগীয় সফরে এসে উত্তরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে ২ আগস্ট এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কর্তৃপক্ষ জানায়, অতীতে যেখানে যেতে সাহস পেতেন না অনেকেই, ফলতো না কোনো ফসল সেখানে যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি সড়ক। কাজের সুবিধার্থে ও প্রকল্পের তদারকির জন্য ভেতরেও রয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট রাস্তা। এরই মধ্যেই জীবনমানে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে স্থানীয় অধিবাসীদের। স্থাপিত হয়েছে মসজিদ ও মাদরাসা।
এলাকার মৃত মানুষের সমাধিস্থ করার কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় কর্তৃপক্ষের অনুদানে করা হয়েছে একটি কবরস্থানও। এছাড়া অনুদানও দেওয়া হয়েছে স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসায়। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পাশেই ৩৫ একর জমিজুড়ে ব্যক্তিমালিকানায় চমৎকার এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘আলীবাবা থিম পার্ক’ নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র।
আরও পড়ুন: কাপ্তাই হ্রদে পানি বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে
প্রতিদিন গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে এ তিস্তা পাড়ে। তাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক ছোটবড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। এতে এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এ প্রকল্প গড়ে ওঠার কারণে রাস্তাঘাট, ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরের জীবন রেখা।
লাটশালা গ্রামের বাসিন্দা সুজন মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকবছর আগে এ এলাকায় আসার মতো কোনো রাস্তা ছিল না। জমিতে ফসল ফলতো না। সেই অনাবাদী জমিতে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় এ এলাকায় রাস্তাঘাট হয়েছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক নামে এক বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, একসময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছেই প্রতি বিঘা জমি বিক্রি করেছি ২০/২৫ হাজার টাকায়। আর এখন একশতক জমির দামই ৪০-৫০ হাজার টাকা। এটি না হলে জমির এতো দাম হতো না।
লিটন মিয়া নামে এক যুবক বলেন, আগে পরিবারের লোকজন রেখে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় কাজে যেতাম। এখন আর বাইরে যেতে হয় না। সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করি। এতে বাড়িও দেখাশোনা হয়।
তারাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও সুন্দরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন বুলু জাগো নিউজকে বলেন, তিস্তার চরের অনাবাদী জমিতে গড়ে ওঠা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে। এলাকার শতশত মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোভাবে দিন পার করছে।
তারাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম লেবু জাগো নিউজকে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র আমার ইউনিয়নে হয়েছে। এ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও জ্বালানি আমদানি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাবে তিস্তা সোলার লিমিটেড।
এ বিষয়ে বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান শায়ান এফ রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একটি রোডম্যাপ আছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। পরিবেশ রক্ষা নিয়ে। সরকার এটি নিয়ে অনেক কাজ করছে। বেক্সিমকো অনেক খাতে পাইওনিয়ার। আমরা মনে করি, এ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত ভবিষ্যৎ জ্বালানির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাই আমরা এ খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই।
তিনি আরও বলেন, এ প্রকল্পে আমাদের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আরও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা করছি। এ প্রকল্প উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতেও ভূমিকা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও অবদান রাখবে।
এসজে/আরএইচ/এএসএম