ধ্বংসের মুখে পোল্ট্রি শিল্প
দেশের অন্যতম পোল্ট্রি শিল্প এলাকা টাঙ্গাইল। কিন্তু বর্তমান সময়ে বহুবিধ আগ্রাসনের কবলে পড়ে স্ব-উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রান্তজনের এই শিল্প আবার ধ্বংসের পথে।
জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের তথ্যমতে, টাঙ্গাইলে রেজিস্ট্রিকৃত লেয়ার খামার সংখ্যা ১২৬৯ ও ব্রয়লার খামার সংখ্যা ১৬৭৮টি। অন্যদিকে জেলা পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা মালিক সমিতির তথ্যমতে, এ জেলায় ছোট বড় খামার আছে ৩০ হাজারের বেশি। তাদের মতে, দেশের এক তৃতীয়াংশ মাংস ও ডিমের চাহিদার যোগানদাতা এই জেলা।
বিগত দিনে খাদ্যে ও ডিমে সিন্ডিকেট হলেও এবার তারা বেছে নিয়েছেন অন্য পন্থা। পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম উপাদান হলো একদিন বয়সী বাচ্চা। তাদের মতে, বাচ্চা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে একদিন বয়সের বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েক গুণ।
এদিকে বাড়তি দাম দিয়েও বাচ্চা পাচ্ছেন না খামারীরা। চাহিদার তুলানায় বাচ্চা সরবারহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ খামারীরা। কোম্পানিগুলো নিজেরাই মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য জারি রেখেছে কৃত্রিম সংকট। যার ফলে স্ব-উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রান্তজনের এই শিল্প আবার ধ্বংসের পথে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পাওয়া গেছে একই চিত্র। সর্বত্রই একদিন বয়সী বাচ্চার জন্য হাহাকার।
খামারীরা জানান, দু’মাস আগে একদিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চার দাম ধরা হতো ৪০ টাকা। এখন সেই বাচ্চার দাম ধরা হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। আগে লেয়ার বাচ্চার দাম ধরা হতো ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এখন সেই বাচ্চার দাম ধরা হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।
খামারীরা আরও জানান, বহুজাতিক কোম্পানীগুলো তাদের উৎপাদিত একদিন বয়সের বাচ্চাগুলো আইন ভঙ্গ করে মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য নিজেদের খামারে ব্যবহার করছে। এতে করে বাজারে বাচ্চার সংকট দেখা দিয়েছে। প্রান্তিক খামারীরা দাম বেশি দিয়েও চাহিদা মোতাবেক বাচ্চা পাচ্ছে না।
তাদের আরও অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে বাচ্চার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজেরা মাংস ও ডিম উৎপাদনে নিয়োজিত হচ্ছে। যার ফলে এক সময় তৃণমূলের খামারগুলো বাচ্চার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে তারা বাজারে ডিম ও মাংসের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ইচ্ছা মাফিক মুনাফা করতে পারবে। সরকারের দুর্বলতা আর আইনের ফাঁক ফোকরের সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দিনের পর দিন সরকারের চোখের সামনেই এই চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছেন বলেই তারা মনে করছেন।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোকার চর গ্রামের লেয়ার খামারী আসাদ বলেন, নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে একজন খামারীকে দিন পার করতে হয়। ভাইরাসজনিত রোগ-ব্যাধির জন্য খামারীকে ২৪ ঘণ্টাই সজাগ থাকতে হয়।
এ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র। অধিকাংশ খামারী এই যুদ্ধে পরাজিত। তারপরও যে দু’একজন জয়ী হয় বা যখনি এই শিল্পের একটু সুদিন আসে তখনি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নতুন নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। তিনি আরও বলেন, এর জন্য অন্যতম দায়ী সিপি কোম্পানি। বহুবার এই সিপি কোম্পানির বিরুদ্ধে খামারীরা আন্দোলন করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার লেয়ার পোল্ট্রি মালিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর ফকির বলেন, ভাইরাসজনিত রোগে অনেকগুলো খামারের মুরগি মারা গেছে। যে সমস্ত খামারগুলোর মুরগি মারা গেছে তারা নতুন করে বাচ্চা উঠাবে কিন্তু বাজারে কোন কোম্পানির বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চা না পাওয়ায় কারণে ওই খামারীদের পথের ফকির হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সন্ধানপুর গ্রামের লেয়ার খামারী হেলাল বলেন, দুই মাস আগে বাচ্চার অগ্রিম বুকিং দিয়ে এখনো অনেক খামারী চাহিদা মোতাবেক বাচ্চা পায়নি। কোম্পানিদের কাছে জানতে চাইলে বলে উৎপাদন কম। কিন্ত তা সত্য নয়। আমাদের কাছে খবর আছে সিপি অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে সিন্ডিকেট করে তাদের ইন্ট্রিগেশন প্রোগ্রাম আবার চালু করে মাংস ও ডিম উৎপাদন শুরু করেছে।
পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা জাতীয় পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন বলেন, আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি তুলেছি এই বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের হাত থেকে এই শিল্পকে রক্ষার জন্য। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সরকার আমাদের দাবি আমূলে নেন না। আমরা খামারীরা দেশের মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। আমরা মনে করি, দেশের পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বহুজাতিক কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত। যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করেছে।
টাঙ্গাইল জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা বিনয় কুমার নাগ জাগো নিউজকে বলেন, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে এখনও আমরা আমাদের সীমাব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সরকারিভাবে একদিন বয়সের বাচ্চা উৎপাদনের কার্যক্রম চালু হয়েছে যা দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যে সকল বহুজাতিক কোম্পানি এসব কাজে জড়িত রয়েছে হাইকোর্টে একটি মামলা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। সরকার পোল্ট্রি শিল্প রক্ষায় যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। অচিরেই এই সকল সমস্যার সমাধান হবে।
এসএস/এমএস