অটোর দৌরাত্ম্য কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হাস্কিং মিল
অটোরাইস মিলের দৌরাত্ম্যে বিগত বছরগুলোতে ঠাকুরগাঁওয়ের হাস্কিং মিলগুলো বন্ধের উপক্রম হয়। তবে বর্তমানে ইএসডিওর বাস্তবায়নে পরিবেশবান্ধব চিমনি স্থাপনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মিলগুলো। এতে কর্মসংস্থানেরও প্রসার হওয়ার পাশাপাশি ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদনে সুদিন ফিরছে মিলারদের।
এছাড়া এসব মিলের উৎপাদিত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফুল গ্রেইন চাল দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। এর চাহিদা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলা খাদ্য অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. শামীম সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই মাসে ঠাকুরগাঁও জেলায় লাইসেন্সধারী হাস্কিং মিল ছিল ১ হাজার ৭৬৯টি ও অটোরাইস মিল ছিল ২৩টি। আর চলিত বছরের জুলাই পর্যন্ত জেলায় লাইসেন্সধারী হাস্কিং মিলের সংখ্যা ৮৮৯টি ও অটো মিল চালু আছে ১৮টি। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ৮৮০টি মিলের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে অর্থাৎ ৮৮০টি হাস্কিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ৫টি অটোরাইস মিলেরও লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।
হাস্কিং মিলের এই ক্রান্তিলগ্নে মিল মালিকদের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও পল্লী সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের উপ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। এই প্রকল্পের আওয়তায় হাস্কিং মিলগুলোতে পরিবেশবান্ধব চিমনি স্থাপন, পরিবেশের দূষণ কমানোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রচলিত খাবার হিসেবে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে খেটে খাওয়া মানুষদের যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে তেমনি দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার পাঁচটি উপজেলায় বন্ধের উপক্রম হওয়া মিলগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
চলতি বছরের বোরো মৌসুমে দেখা গেছে, আগে যেখানে মিলগুলোর চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়াসহ ছাই ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করতো, এখন সেগুলোতে পরিবেশবান্ধব নতুন চিমনি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও মিলের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে। মিলে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের কাজ করার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ পোশাক পরিচ্ছদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট এবং তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা এড়াতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, অসুস্থতার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্রের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মিলগুলোতে।
পরিবেশবান্ধব চিমনি স্থাপন ও ফুল গ্রেইন চাল প্রক্রিয়াজাতকরণ মিলের শ্রমিক আইয়ুব আলী বলেন, এখানে আমাদের পোশাক, রোদ না লাগার জন্য বাঁশের তৈরি টুপি, খাওয়ার পানি ও টয়লেটর সুব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই আছে। যা আগে কখনো দেখিনি। এতে কাজ করতে আমাদের অনেক সুবিধা হয়।
মেসার্স আবুল কাশেম হাস্কিং মিলে কর্মরত ঝড়ি বেগম নামে এক শ্রমিক বলেন, আগে যে মিলগুলোতে আমরা কাজ করতাম সেগুলোতে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতো না। সেজন্য বিশেষ করে আমাদের নারীদের সমস্যা হতো। আর এখন শুধু টয়লেটের ব্যবস্থা নয়, আমাদের জন্য নিরাপদ পানি, পোশাকসহ কাজ করার সময় অসুস্থ হলে ওষুধেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মিলে।
মিলের ম্যানেজার হারুনুর রশিদ বলেন, রোদ হলে একেকটি মিলে মাত্র দুই দিনে পুষ্টি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ চাল প্রায় ২০০ বস্তা উৎপাদন ও প্রস্তুত করা হয়। প্রস্তুতকৃত চালের মধ্যে ফুলে গ্রেইন, গাঞ্জিয়া, বিআর ২৮, বিআর ২৯, বিআর ৮৪ ও জিংক চাল প্রস্তুত করা হয়।
মেসার্স আবুল কাশেম হাস্কিং মিলের মালিক মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘ইএসডিও’র সহয়োগিতায় আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করছি। এসব চাল উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি ও লাভের মুখ দেখছি। চাহিদা থাকায় আমাদের হাস্কিং মিলে উৎপাদিত চাল স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক হাস্কিং মিল মালিক বলেন, আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারছি শুধু ইএসডিওর সহযোগিতায়। জিংক ও ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদনে এবং বাজারজাতকরণেও সহযোগিতা করছে তারা। তাছাড়াও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বিএসটিআই, এসজিএস এর মাধ্যমে আমাদের উৎপাদন করা চাল পরীক্ষা করা হয়। এতে তারা এ চালে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ৯টি উপাদান পান। আর অটো মিলের চালে তেমন পুষ্টি বা ভিটামিন না থাকায় মানুষ এখন হাস্কিং মিলের চালের দিকে ঝুঁকছে বেশি। তাই ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন তারা। এছড়াও সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে আরও বেশি করে এ চাল উৎপাদন করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
স্থানীয় শীববাড়ি গ্রামের আনারুল হোক নামে এক ভোক্তা বলেন, অটো মিলের কারণে আগে আমাদের এদিকে হাস্কিং মিলগুলো বন্ধ ছিল। তাই আমরা অটোমিলের চাল খেতাম। ছয় মাস আগে এক প্রতিবেশীকে দেখি ফুল গ্রেইন চাল কিনতে ও ভাত খেতে। তার কাছে জানার পর আমিও ফুল গ্রেইন চাল ক্রয় করি ও এখনো সেই চালের ভাত খাচ্ছি পরিবারের সবাই। চালগুলো অটো মিলের চালের তুলনায় অনেক ভালো ও স্বাদযুক্ত।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জাগো নিউজকে বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে মানুষের যেমন স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হচ্ছে তেমনি নিরাপদভাবে শ্রমিকদের কাজ করার ও কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর এর সুফল সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আগমীতে শুধু ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর জেলায় নয় এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ইএসডিওর এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান ঠাকুরগাঁও সদরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা খন্দকার আবুল বাসার। তিনি বলেন, উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। এতে যেমন পরিবেশদূষণ রোধ হবে তেমিন স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যও নিশ্চিত হবে। আমরা চাই তারা সকল হাস্কিং মিলগুলো এই প্রকল্পের আওতায় আনুক।
এফএ/জিকেএস