বন্ধ হয় না ভাঙন, জলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা
দুইমাস আগে তিন দফা বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সুনামগঞ্জে। এতে তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ে জেলার সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সুনামগঞ্জের ২০ লাখেরও বেশি মানুষ।
বন্যা পরিস্থিতি একমাস ধরে স্বাভাবিক হলেও নতুন আরেক দুর্ভোগে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে নদীভাঙন। নদীগর্ভে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সদরপুর গ্রাম। গ্রামটিতে বসবাস পাঁচ শতাধিক পরিবারের। কিন্তু বছর বছর বন্যা পরবর্তী সময়ে গ্রামটিতে দেখা দেয় ভয়াবহ নদীভাঙন। এরই মধ্যে শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। যাদের ঘরবাড়ি নদী গ্রাস করেছে তাদের মধ্যে একজন দিনমজুর ইসমাইল মিয়া। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে চার লাখ টাকা নিয়ে ১৪ একর জায়গায় নির্মাণ করেছিলেন শখের একটি বাড়ি। কিন্তু সেই শখের বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয়নি ইসমাইলের। বানানোর চার বছরের মাথায় নাইন্দা নদীর গ্রাসে তার শখের বাড়িটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এখনো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বুকভরা কষ্ট নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন ইসমাইল মিয়া।
আরও পড়ুন: ত্রাণের ঘর, তাও গেলো নদীতে
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদীতে আমার শখের বাড়িটি তলিয়ে গেছে। এখন আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে অন্যের বাড়িতে। হায়রে কপাল!’
শুধু নাইন্দা নদী নয়; জেলার সুরমা, কুশিয়ারা, নলজুর, বটেরখাল, মহাশিং ও পুরাতন সুরমা নদীর বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙছে নদীর পাড়। এমনকি জেলার ১২ উপজেলার ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, গ্রামীণ জনপদ, মসজিদ ও কবরস্থান এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সময় যত যাচ্ছে ততই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ভাটির জেলার নদীভাঙন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ নদীভাঙন দেখা দিয়েছিল দোয়ারাবাজারে। যে কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে নদীভাঙন থেকে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর বাঁচাতে ১৯১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ শুরু করে পাউবো। এছাড়া ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জেলার ১২ উপজেলায় যে স্থানগুলোতে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে সেসব জায়গায় অস্থায়ীভাবে কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ৩-৪ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। তবে সেই কাজ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। প্রতিনিয়ত নদীর করাল গ্রাসে ঘরবাড়ি ভাঙতে থাকায় আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন ভাঙন এলাকার মানুষ।
আরও পড়ুন: মেঘনার তীররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন নিয়ে বাড়ছে হতাশা
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, স্থায়ীভাবে নদীভাঙন ঠেকাতে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে নদীর যেসব স্থানে প্রতিবছর ভাঙন শুরু হয় সেগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত কতগুলো ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে, ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো কতটি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে তার তালিকা চাওয়া হয় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কাছে। তবে তার কাছে শুধু ২০২০ সালের তালিকা আছে বলে জানান।
সেই তালিকায় দেখা যায়, সুনামগঞ্জ সদর, ধর্মপাশা, শাল্লা, দিরাই ও জামালগঞ্জসহ পাঁচ উপজেলার নদীভাঙনে দিশেহারা ২৪০টি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে মোট দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: সাঙ্গুর পানিতে ডুবছে ঘরবাড়ি, গাছ পড়ে রুমা-থানচি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর নদীতে ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে কিন্তু তার কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে যারা ২০২০ সালে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের ১০ হাজার টাকা করে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে।
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের চলতি মাস পর্যন্ত সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় প্রায় এক হাজার ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনোয়ার উজ জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপজেলার সদরপুর গ্রামের নাইন্দা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমরা গ্রামটি পরিদর্শন করেছি। যারা নদীর তীরে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। নদীর ভাঙন রোধে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
আরও পড়ুন: ‘শেখের বেটির কাছে তিস্তা নদীর বান্দোন চাই’
দোয়ারাবাজার ইউএনও আরিফ মোর্শেদ মিশু জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা নদীভাঙন থেকে রক্ষায় ১৯১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেটির কাজ দ্রুত শেষ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, সুনামগঞ্জ হাওর এলাকা। এ কারণে প্রতিবছর নদীভাঙন দেখা দেয়। তবে নদীভাঙনে যাদের ঘর হারিয়েছে তারা যদি উপজেলা পর্যায়ে আবেদন করেন তাহলে পুনর্বাসন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে থাকতে চাইলে সেখানেও তারা থাকতে পারবেন।
এসআর/এএসএম