কক্সবাজারে বন্যা

৬০ ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ০৮ আগস্ট ২০২৩

টানা পাঁচ দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ডুবে আছে রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি। এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যাদুর্গতদের।

মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর একাধিক অংশে বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাথমিক হিসাবে ৫১ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক এবং আড়াই কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে।

এদিকে সড়ক তলিয়ে থাকায় মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) সকাল থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

jagonews24

আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, রোববার বিকেল ৩টা থেকে সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। সোমবার ১২টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৯৩ মিলিমিটার। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।

এদিকে, ভারী বর্ষণের কারণে দোহাজারী হাইওয়ে থানার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর কসাইপাড়া, পাঠানীপুল, দোহাজারী পৌরসভার কলঘরব্রিজ এলাকায় রাস্তার উপর প্রায় আড়াইফুট এবং সাতকানিয়ার কেউচিয়ার নয়াখাল, নতুন রেললাইন, কেরানীহাটবাজার এবং ছদাহার হাসমতের দোকান এলাকায় মহাসড়কের ওপর দিয়ে একফুটের বেশি পানি উজান থেকে ভাটির দিকে প্রবাহিত হলে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। কিছু বড় যান ধীরগতিতে চললেও ছোট ও মাঝারি যান চলাচল বন্ধ থাকে। এর আগে সোমবার থেকে বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া এলাকায় পানি উঠে কক্সবাজার-চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়।

এদিকে সামুদ্রিক জোয়ারের ঢেউতে মেরিনড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে। মেরিনড্রাইভের কিছু অংশে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নতুন করে আরও কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়।

jagonews24

সোমবার রাতে টানা বৃষ্টিতে শহরের পর্যটন জোনের প্রধান ও উপসড়কে এক-দেড়ফুট পানি প্রবাহিত হয়। অনেক হোটেলের নীচতলায় পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়। সৈতকপাড়ায় অনেক বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। একই অবস্থা পাহাড়তলী, লাইটহাউজ, রহমানিয়া মাদরাসা এলাকায়ও।

চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টি এবং জোয়ারের ঢেউতে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চকরিয়ার পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি। ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে কাঁকড়া, লক্ষ্যরচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরেজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালী ইউনিয়ন। মাতামুহুরীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কইন্যারকুম, বিএমচর, মেহেরনামা বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। আরও একাধিক এলাকায় পাউবোর বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং বৃষ্টি না থামলে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা আছে।

জেলা পরিষদের ঈদগাঁও উপজেলার সদস্য মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ঈদগাঁওর জালালাবাদ, ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, ইসলামপুর, পোকখালী ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রামে বন্যার পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামের সড়কগুলোও। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কৃষিজমিসহ তলিয়ে গেছে কয়েকশ হেক্টর আমনের বীজতলা। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, হ্যাচারি, পুকুর।

jagonews24

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলার ফতেখাঁরকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, চাকমারকুল, রাজারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঁকখালীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতে বিভিন্ন গ্রামের সাঁকো ভেসে গেছে। স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করছেন। বন্যাদুর্গতের জেলা প্রশাসকের দেওয়া দুই টন চাল ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবারও।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংঝা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান জাগো নিউজকে বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নিচু হাওয়ায় পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়।

পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, পাহাড়ি ঢলে পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, টৈটং, বারবাকিয়া, শিলখালী ও রাজাখালী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানি, খাবারের সংকট। বানৌজা শেখ হাসিনা সড়কসহ অনেক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামে বাসাবাড়ি পানিবন্দি।

jagonews24

অপরদিকে সোমবার বিকেলে চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সবুজ পাড়া (বরঘোনা) এলাকার মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান তাবাচ্ছুম (১) ও মোহাম্মদ সাবিদ(৫) বাড়ির দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। এ সময় আহত হন নাজিম ও তার স্ত্রীসহ আরও চারজন। একই সময় উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯ এর এ/৬ ব্লকে ঘরের ওপর পাহাড় ধসে ওই ক্যাম্পের আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) এবং তাদের মেয়ে মাহিম আক্তার (২) মারা যান।

একইসময় রামুর রাজারকুলের মৌলভীপাড়ায় বাড়ির উঠানে আসা বন্যার পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে সৌদি প্রবাসী মৌলভী ওবাইদুল হকের শিশু কন্যা সামিয়া (২)।

jagonews24

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জাগো নিউজকে বলেন, জেলার ৬০ ইউনিয়নে তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় প্রাণহানি হয়েছে পাঁচজনের। দুর্গত মানুষদের জন্য ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। সেসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, চকরিয়া-পেকুয়ায় ৪৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক, উখিয়ায় তিন কিলোমিটার কাঁচা সড়ক এবং টেকনাফ মহাসড়কে আড়াই কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিবর্ষণে দুর্গতদের এরই মধ্যে ৫৮ টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ হয়েছে। বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে সব বিভাগ একীভূত হয়ে কাজ করছে।

jagonews24

দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন

ভারী বর্ষণের ফলে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল কার্যক্রম শুরু করেছে।

১০ পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও অন্য সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ এবং বিভিন্ন তথ্যের জন্য রামু সেনানিবাসে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে।

এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।