২ যুগ পর ঘুম ভাঙলো পাকশী রেল কর্তাদের
পাবনার ঈশ্বরদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন রেলের জমি কৃষি কাজের জন্য ইজারা নিয়ে দুই যুগ ধরে বালুর রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আর বালু পরিবহনে চলাচল করা ট্রাকের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে নদী তীররক্ষা বাঁধ। রেল কর্মকর্তারা বিশেষ সুবিধা নিয়ে কৃষি জমিতে বালু ব্যবসার সুযোগ দিয়েছেন বলে স্থানীয়দের ধারণা।
তবে এ দুর্নাম ঘোচাতে এবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশের বালু মহাল ও বালুর স্তূপ সরিয়ে নিতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কয়েক দফা পাকশী ইউনিয়নজুড়ে মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বালু অপসারণ করা না হলে নিলামের মাধ্যমে বালু বিক্রি করে দেওয়া হবে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু কেপিআইভুক্ত এলাকা। এ ব্রিজের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন, ড্রেজিং, মাছ ধরা, নৌকা ভ্রমণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে প্রবেশ পথে কাঁটাতারের বেড়া এবং মূল ব্রিজের দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন রেলের জমি কৃষি কাজের জন্য লিজ নিয়ে কিছু ব্যক্তি অবৈধভাবে বিশাল বিশাল বালুর স্তূপ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাশে পদ্মার তীররক্ষা বাঁধের বিশাল এলাকাজুড়ে বালুর স্তূপ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার ট্রাক বালু বিক্রি হয়। টাকার হিসাবে এখানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার বালু বেচাকেনা হয়। এসব বালুর স্তূপ থেকে ট্রাকপ্রতি এবং বালুর ফুট হিসাবে চাঁদা আদায় করা হয়। এ চাঁদার ভাগ বাটোয়ারা হয় নানা মহলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস শুরু থেকেই বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরে ক্ষমতাসীন দলের আরও অনেকে এ ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও পাকশী নৌ-পুলিশ এসব দেখেও যেন দেখে না। বালু ব্যবসায় তাদেরও সহযোগিতা রয়েছে। রেলের জমিতে বালু ব্যবসার সুযোগ দিয়ে রেল কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নেন এমন দুর্নামও রয়েছে। এবার রেল কর্মকর্তারা তাদের দুর্নাম ঘোচাতে ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপত্তা জোরদার করতে বালু ব্যবসায়ীদের বালু সরিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে এনামুল হক বিশ্বাস বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় বালুর ব্যবসা করতাম। এখন আর করি না। আমার কোনো বালু মহাল বা বালুর স্তূপ নেই।
তিনি আরও বলেন, এখানে যারা বালু ব্যবসা করে তারা রেলের জমি লিজ নিয়েছে। বালুর স্তূপ সরিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের সময় দেওয়া প্রয়োজন। আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বালু অপসারণ করা সম্ভব না।
বালু ব্যবসায়ী ও যুবলীগ নেতা মাসুদ রানা মাসুম জাগো নিউজ বলেন, বালু অপসারণের জন্য মাইকিং করা হয়েছে শুনেছি। এত অল্প সময়ের মধ্যে বালু সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। এখানে কয়েক কোটি সিএফটি বালু রয়েছে। এগুলো অপসারণ করতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে। রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে যেন আর নতুন করে বালু স্তূপ করা না হয় এবং স্তূপ বালু সরিয়ে নিতেও বলা হয়েছে।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকার আশপাশে আগে নদী থেকে বালু তোলা হলেও এখন হয় না। অন্য এলাকা থেকে নৌকায় বালু এনে এখানে স্তূপ করে ব্যবসা করা হয়। নৌকায় বালু আনতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয় বলে শুনেছি। বালু ব্যবসার সঙ্গে কোনোদিনই জড়িত ছিলাম না।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও নদীর তীররক্ষা বাঁধের ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেল তাদের জমি ইজারা দিয়েছে। তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা কী বলব। রেল, নৌ-পুলিশ ও প্রশাসন তো কিছুই বলে না।
পাকশী ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা কার্যালয়ের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে বালুর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এ স্থানটি রেলের। অনেকেই ভেবে থাকেন রেলের ভূ-সম্পদ অফিস ও রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে থাকে। দীর্ঘ চাকরি জীবনে কোনো বালু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি টাকাও আমি নিজে নিইনি এবং কোনো অফিসারকে নিতেও দেখিনি।
পাকশী রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিইএন-২) বীরবল মণ্ডল বলেন, বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নদীর তীররক্ষা রাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপত্তার স্বার্থে বালু মহাল বা বালুর স্তূপ এখান থেকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বালুর স্তূপ এখান থেকে সরানোর পর ব্রিজের নিরাপত্তার জন্য আশপাশের এলাকা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে।
পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা থেকে বালুর স্তূপ সরিয়ে নেওয়ার জন্য মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বালু ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সরিয়ে না নিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেখ মহসীন/এমআরআর/জেআইএম