মুন্সিগঞ্জ

হিমাগারের আলু বাজারে আসতেই কেজিতে বাড়ে ১০ টাকা

আরাফাত রায়হান সাকিব আরাফাত রায়হান সাকিব , মুন্সিগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৫:২১ পিএম, ১৮ জুলাই ২০২৩

মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলোতে এখনো বিপুল পরিমাণ আলুর মজুত রয়েছে। এরপরও বাজারে বেড়েই চলেছে দাম। তবে এরইমধ্যে প্রান্তিক কৃষকদের আলু শেষ হয়ে যাওয়ায় মূলত বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ী বা ব্যাপারীদের হাতে। ফলে তারা লাভবান হলেও কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার সচল ৬৩টি হিমাগারে বর্তমানে মজুত ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩৩ মেট্রিক টন আলু। এর মধ্যে খাবার আলু ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন এবং বীজ আলু ৭৭ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন। মূল্যবৃদ্ধির পর গত তিন সপ্তাহে হিমাগার থেকে বাজারজাত হয়েছে ১৮ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন আলু।

অধিদপ্তদরের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে মুন্সিগঞ্জে হেক্টরপ্রতি আলু উৎপাদনে গড়ে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন বা ৩০ হাজার ৭৫০ কেজি। অর্থাৎ এবছর প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। পরিবহন ও হিমাগারে সংরক্ষণ মিলিয়ে খরচ ১৬-১৭ টাকা। বর্তমানে সে আলু দ্বিগুণেরও বেশি দামে ভোক্তারা কিনছেন ৪০ টাকায়।

সরেজমিনে জেলার কয়েকটি হিমাগার ঘুরে দেখা যায়, এসব হিমাগারে এখনো বিপুল পরিমাণে আলু আছে। আলুর বেচাকেনা ও বাছাই চলছে। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৭-২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: হিমাগার-মজুতদারদের কারসাজিতে ৩ গুণ আলুর দাম

খুচরা বাজারে দেখা যায়, ক্রেতাদের আলু কিনতে হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি। অর্থাৎ পাইকারি বাজার থেকে ভোক্তাদের প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরমধ্যে চলতি বছর উৎপাদিত আলুর প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষকরা বিক্রি করেছেন। হিমাগারে আলুর যে মজুত রয়েছে তা মূলত ব্যবসায়ী বা ব্যাপারীদের। এতে বাজারের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। ফলে বাজারে আলুর মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

তবে ভিন্ন কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, পরিবহন, হিমাগার, আলু বাছাইয়ে শ্রমিকদের খরচ দিয়ে তাদের এখনো আশানরূপ লাভ হচ্ছে না।

মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মুন্সিরহাট এলাকার একটি হিমাগারে কথা হয় ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের পর শ্রমিকরা বাড়ি চলে যাওয়ায় হিমাগারের আলু বাছাই ও বাজারজাত করা যাচ্ছিল না। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়েছিল। এ সপ্তাহে আবার কমেছে কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা।

আরেক ব্যবসায়ীর ভাষ্য, যখন লোকসান হয় তখন সরকার আমাদের জন্য কী করে? সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আলুর দাম বেড়েছে। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণে ভাড়া দিতে হয় ২৬০ টাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন সংরক্ষণে রাখলে আলু শুকিয়ে কিছুটা ওজন কমে। তারপর বারবার বাছাইয়ে শ্রমিক খরচ আছে। তার মতে, এখন কিছুটা লাভ হলেও আশানরূপ লাভ করতে পারছেন না। কয়েক বছর লোকসানের পর লাভ হলেই চোখে পড়ে যায় সবার।

আরও পড়ুন: আলুর কেজি ৫০ টাকা

স্থানীয় সুলতান কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার আব্দুল বাতেন বলেন, আমাদের হিমাগারের ৩ লাখ ১০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করা যাবে। এবছর সংরক্ষণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার বস্তা। মুন্সিগঞ্জে এবছর আলুর উৎপাদন কম হওয়ায় সংরক্ষণও কম হয়েছে। এখন চাহিদা বেশি থাকায় বাজার ভালো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি হিমাগারের ব্যবস্থাপক বলেন, এখানে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। আলুর ব্যবসা করে ব্যাপারীরা। ২০২১-২২ সালে লোকসান হয়েছে। আমাদের হিমাগারে গতবছরে চেয়ে এবছর ১ লাখ ২০ হাজার বস্তা কম সংরক্ষণ হয়েছে। মৌসুমের প্রথম পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা ১০-১১ টাকায় আলু কিনতে পেরেছিলেন। তবে কয়েকদিনের মধ্যে সেটি ২২ টাকায় কিনতে হয়েছে। পাইকারি বাজারে মাঝখানে ৩১ টাকা কেজি হয়েছিল। বর্তমানে ২৮ টাকা। ভোক্তাপর্যায়ে ৪০ টাকা অনেক বেশি, এর জন্য ব্যাপারীরা নয়, খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী।

দাম কমছে না খুচরা বাজারে
খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাইকারিতে দামবৃদ্ধি পাওয়ায় তারা কম করে কিনে রাখছেন। তবে পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে কেজিতে ১০-১২ টাকা বেশি দামের বিষয়ে তারা বলছেন বিভিন্ন কথা।

আবুল দেওয়ান নামে এক দোকানদার জাগো নিউজকে বলেন, বাছাই ছাড়া আলু পাইকারি ২৭-২৮ টাকা কেজি কিনতে হয়। বাছাইয়ের পর বস্তাপ্রতি কিছুটা কমে। এছাড়া এক বস্তায় ৫০ কেজির মধ্যে ৮-১০ কেজি ছোট আলু থাকে। সেগুলো বিক্রি করতে হয় কম দামে। দেখা যাচ্ছে, গড়ে আমাদের ৩৪-৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। এতে কেজিতে পাঁচ-ছয় টাকা লাভ থাকে।

পাশের আরেক দোকানদার জানান, ৫০ কেজির এক বস্তা আলু তাদের কিনতে হচ্ছে ১৩০০ টাকায়। ছোট-বড় মিলিয়ে মোট বিক্রি হয় ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায়। বস্তায় লাভ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তার মতে, বাজারে অন্য সবজি কম থাকায় আলুর দাম বেশি। সবজির সরবরাহ বাড়লে আলুর দাম কমবে।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকতা এ বি এম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, জেলায় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। সংকটের অজুহাতে দামবৃদ্ধি অযৌক্তিক। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদন নিয়ে কাজ করায় বাজার তদারকির বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। মূলত এখনকার অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকরা উৎপাদনের পরপরই জমিতে ও পরবর্তীতে হিমাগরে আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। যারা আগেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন তারা লাভ পাচ্ছেন না। এছাড়া কিছু বড় কৃষকের কাছে আলু রয়েছে, তারা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। বাকি মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীলা লাভ পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: আলুর সংকট নেই, তবুও লাফিয়ে বাড়ছে দাম

মুন্সিগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, এরমধ্যে হিমাগারগুলোতে মনিটরিং শুরু হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, একটি হিমাগারেই কোনো ধরনের রশিদ ছাড়াই বেচাকেনা হচ্ছে আলু। বদল হচ্ছে ছয়-সাত হাত। এক্ষেত্রে কেজিতে এক টাকা করে দাম বাড়লেও ছয়-সাত টাকা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এরমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছি। সামনে আরও কঠোর মনিটরিং করা হবে। বাজারে জোরালো মনিটরিং করা গেলে অযৌক্তিক দাম কমে যাবে।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।