কুড়িগ্রাম

খাদ্য গুদামে ধান দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, বঞ্চিত কৃষক

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত: ১১:০২ এএম, ১১ জুলাই ২০২৩

কুড়িগ্রামের উলিপুর সরকারি খাদ্য গুদামে কৃষকের বদলে ধান দিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকদের তালিকাতে রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের স্বজনসহ জমিজমা না থাকা কৃষকরাও। উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির পরোক্ষ যোগসাজশে এ অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের দেওয়া সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা।

রোববার (৯ জুলাই) দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলা খাদ্য গুদাম চত্বরে অর্ধশতাধিক ট্রলি, ট্রাক্টরে করে ধানের বস্তা নিয়ে অবস্থান করছেন ধান ব্যবসায়ীরা। এসময় কোনো কৃষকের দেখা পাওয়া যায়নি। এসময় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে একাধিক কৃষকের কৃষি কার্ড, এনআইডি এবং কৃষকের সই করা ফাঁকা চেকের পাতা দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাঠ পর্যায় থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করেন এসব ধান ব্যবসায়ী। তাদের কাছ থেকেই ধান কিনছে খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ। উপজেলা খাদ্য গুদামকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিল চাতাল মালিকদের সিন্ডিকেট চক্রের কারণে নানা ওজুহাতে কৃষকদের ধান ফেরত পাঠানো হয়।

অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেট চক্রটি নানা কারসাজির মাধ্যম ভূমিহীন, দিনমজুর ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের লটারিতে বিজয়ী দেখিয়ে তাদের নামে গুদামে ধান দিচ্ছে চক্রটি। একইভাবে রোববার ট্রলি ও ট্রাক্টরে করে এনে ধান গুদামে ঢোকানোর চেষ্টা করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। তালিকার সূত্র ধরে উপজেলার ধামশ্রেণী, গুনাইগাছ ও থেতরাই ইউনিয়নসহ পৌরসভা এলাকায় অনুসন্ধান করলে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসে।

লটারিতে উলিপুর উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেটের পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম রয়েছে। তালিকার ৩ নম্বরে মাহফুজার রহমান বুলেট, ৭৮ নম্বরে বাবা লুৎফর রহমান, ৭৬ ও ৭৭ নম্বরে দুই চাচা তৈয়বুর রহমান ও হাফিজার রহমান এবং ৭৫ ও ৭৯ নম্বরে দুই ভাই তৈফিক রহমান ও ফয়সাল রহমানের নাম রয়েছে। এছাড়া তালিকায় রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের স্বজন, প্রতিবেশী, বাড়ির কাজের লোকসহ অনেকের নাম।

রোববার কথা হয় পৌরসভার মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা মাসুদ রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শনিবার রাত ১১টা থেকে ১৫০ বস্তা ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে পড়ে আছি। রাত থেকে আমরা পড়ে থাকলেও গুদাম কর্তৃপক্ষ গেট খোলে না। কিন্তু সকাল বেলা সিন্ডিকেট চক্র আর বড় ব্যবসায়ীরা আসার পর গেট খুলে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেট সদস্যদের ধান গুদামে নিচ্ছে আর আমাদের ধানের মান খারাপ দেখিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।’

একই এলাকার বাসিন্দা সেকেন্দার আলী বলেন, ‘কার্ড নিয়ে খাদ্য গুদামে ধান দিতে এসেছিলাম। কিন্তু ধানের আর্দ্রতা দেখিয়ে ধানের ট্রলি ফেরত দিলেন ওসিএলএসডি (উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা)। আমার ধানের চেয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিম্নমানের ধান কিনে গুদামে ভরানো হয়েছে। শুধু সিন্ডিকেট সদস্য না হওয়ায় আজ আমার ধান নিলো না তারা।’

তিনি আরও বলেন, এখানে যারা ধান নিয়ে আসছেন তাদের কেউই কৃষক না। সবাই কৃষকের কাছ থেকে কার্ড কিনে নিয়ে ধান দিতে আসছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য গুদামে এ অনিয়ম চলছে।

ট্রলিচালক জহুরুল হক বলেন, ‘আমি এর আগেও ধান নিয়ে এসেছি ব্যবসায়ীদের। এখানে কোনো কৃষক ধান দেননি। সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা ধান দিচ্ছেন।’

খাদ্য গুদামে ধান দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, বঞ্চিত কৃষক

খাদ্য গুদামে ধান দেওয়া কৃষকের তালিকায় রয়েছে গুনাইগাছ ইউনিয়নের বাসিন্দা মকবুল হোসেনের নাম। তিনি বলেন, ‘আমি এবার ৫০ শতক জমিতে ধান আবাদ করেছি। প্রায় ৩০ মণ ধান পেয়েছি। সেখান থেকে কিছু ধান বাজারে বিক্রি করেছি এবং খাওয়ার জন্য কিছু রেখেছি। খাদ্য গুদামে আমি এবং আমার পুত্রবধূ কোনো ধান বিক্রি করেনি। তালিকায় আমাদের নাম কিভাবে এলো বুঝতে পারছি না।’

একই ইউনিয়নের নাগড়াকুড়া টি-বাঁধ এলাকার বাসিন্দা ছাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন আগে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাকসেসের শিক্ষক ওবায়দুল আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে কৃষি কার্ডটি নেন। আমি খাদ্য গুদামে কোনো ধান বিক্রি করেনি। আমার যা ধান ছিল তা বাইরে বাজারে বিক্রি করেছি।’

ধামশ্রেণী এলাকার তালিকাভুক্ত কৃষক পলাশ বলেন, ‘আমার এবং আমার মায়ের নাম তালিকায় রয়েছে। ধানও দিয়েছি, টাকাও পেয়েছি এক লাখ ৮০ হাজার ২০ টাকা।’

কোথায় ধান দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি কুড়িগ্রাম খাদ্য গুদাম অফিস এবং গুনাইগাছ খাদ্য অফিসের নাম বলেন। তবে ধান কোথায় দিয়েছেন তার কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে সটকে পড়েন এ কৃষক।

এ বিষয়ে উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেট ফোনে বলেন, আমি একটি মিটিংয়ে আছি। পরে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। পরে তিনি আর কল রিসিভ করেননি।

খাদ্য গুদামে ধান দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, বঞ্চিত কৃষক

উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) শফিকুল ইসলাম বলেন, চলতি মৌসুমে আমন-বোরো খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয় গত ১৮ মে। আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি দরে কৃষকপ্রতি তিন টন করে ধান এবং ৪৭ জন চুক্তিবদ্ধ মিলারের কাছ থেকে ৪৪ টাকা দরে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবারে উপজেলায় এক হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন ধান এবং এক হাজার ৪৮১ মেট্রিক টন চাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯ জুলাই পর্যন্ত ৪০২ মেট্রিক টন ধান এবং এক হাজার ২৪০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি এসব তথ্য দিলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কেনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, সরকারিভাবে আমন-বোরো ধান বিক্রির জন্য উপজেলা থেকে দুই হাজার ১৫৬ কৃষক আবেদন করেন। যারা আবেদন করেছেন তাদের তালিকা আমরা কৃষি বিভাগ থেকে উপজেলা খাদ্য বিভাগের কাছে সরবরাহ করেছি। তবে তালিকায় ব্যবসায়ীরা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহমুদুল হাছান বলেন, কৃষকের তালিকা কৃষি বিভাগ তৈরি করে। সেই তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কৃষক প্রতিনিধি। খাদ্য বিভাগ শুধু তালিকা অনুযায়ী নির্বাচিত কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে। যেহেতু অনিয়মের বিষয়টি জানতে পারলাম, এটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফজলুল করিম ফারাজী/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।