বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ
মেয়াদ শেষ হলেও শুরুই হয়নি কাজ, প্রকল্পের ধীরগতিতে বাড়ছে জটিলতা
বিগত চার মাস ধরে শুধু সম্ভাব্যতা যাচাই কাজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্পের কাজ। এর আগেও শুরু থেকে কয়েকবার পিছিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি। এখন প্রাথমিক কাজ শুরু নিয়ে জেলা প্রশাসন বলছে নানা জটিলতার কথা। আর এসব কারণেই রেলপথ প্রকল্পে অতিরিক্ত মাশুল দিয়ে সরকারকে জমি কিনতে হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বিগত ২০০৭ সালে পরিকল্পনার পর ২০১৮ সালে অনুমোদন মেলে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্পের। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এখন জুন শেষে দেখা গেছে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংশ্লিষ্ট এলাকায় জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পর্যন্ত দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন। দেরি হওয়ার কারণে এখন অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে বলে স্বীকারও করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। কারণ প্রকল্প এলাকায় যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেগুলোর দাম আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের আশঙ্কা, জমি অধিগ্রহণে এখন সরকারকে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। আর এটা হলে প্রকল্প ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন: বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ হলে কমবে ২০০ কিলোমিটার
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিলুফা ইয়াসমিন জানান, মোট রেললাইনের অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে বগুড়া অংশে ৪৭৯ দশমিক ১৫ একর, আর সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬০ একর রয়েছে। এরমধ্যে প্রকল্পের পক্ষ থেকে একটি জরিপ কাজ চালানো হলেও সেটি জেলা প্রশাসনকে নিয়ে করা হয়নি। যার কারণে এখন দুই জেলার প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। গত বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) বগুড়া অংশের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ১২ জুলাই থেকে সিরাজগঞ্জ অংশে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হবে। এই দলে পাঁচজন সার্ভেয়ার ও দুজন কানুনগো মিলে মোট ১২ জন রয়েছেন।
দেরিতে কাজ শুরু প্রসঙ্গে নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্প কর্মকর্তার কাছ থেকে একটি ফিল্ড রিপোর্ট তাদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে মাঠ জরিপ শুরু করতে দেরি হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও, তা এখন আর সম্ভব নয়। এখন ২০২৩ সালে ৮৬ দশমিক ৫১ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেলপথের ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শুরু করাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে প্রকল্পের ভারতীয় পরামর্শক দলের বিস্তারিত সমীক্ষা, নির্মাণাধীন রেলপথ, রেলসেতু, রেলস্টেশন, সিগন্যাল এবং অন্য সব স্থাপনার নকশার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা জানান, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েস্ট জোন এই রুটে ডুয়েল গেজ রেললাইন স্থাপন করছে। পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের বগুড়া থেকে শহীদ এম. মনসুর আলী স্টেশন, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েল গেল রেললাইন স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। শুরুতেই রেলপথের ডুয়েল গেজের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
এই রেলপথে মোট ৯টি স্টেশন হবে। এগুলো হলো শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন, রায়পুর স্টেশন, নলকা কৃঞ্চদিয়া স্টেশন, চান্দাইকোনা স্টেশন, রায়গঞ্জ স্টেশন, ছোনকা স্টেশন, শেরপুর স্টেশন, আড়িয়াবাজার স্টেশন ও রানিরহাট স্টেশন। এর মধ্যে মনসুর আলী স্টেশনে তিনটি জংশন তৈরি হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন: বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন নির্মাণে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি সই
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, জমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ২০২৪ সালের দিকে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হতে পারে।
তিনি স্বীকার করেন, নানা কারণে উভয় দিকের জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করতে অনেক দেরি হয়েছে। তবে রেললাইন স্থাপন কাজের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া এবং নকশা প্রস্তুতের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, নতুন রেলওয়ে রুটের জন্য দুই জেলার ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এরমধ্যে বগুড়া অংশে রয়েছে প্রায় ৪৭৯.১৫ ও সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬০ একর। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ বাবদ এক হাজার ৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ মিলেছে। মাঠ জরিপ শেষ হলে নোটিশ করার পর এই টাকা দেওয়া শুরু হবে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্টির সহ-সভাপতি মাহফুজুর রহমান বলেন, বগুড়া থেকে ঢাকায় যেতে হলে ট্রেনে করে সান্তাহার জংশন হয়ে নাটোরে যেতে হয়। এরপর পাবনার ঈশ্বরদী ঘুরে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে উঠতে হয়। একই পথে রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম বা রংপুরের ট্রেনও চলে। এতে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে যাত্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুধু বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকেই তিনটি জেলা ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। আর প্রায় ৩২৪ কিলোমিটার পথে ঢাকায় যেতে লাগে প্রায় আট থেকে নয় ঘণ্টা। সড়কে গেলে এটি ২০০ কিলোমিটারের পথ। সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুতে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উত্তরবঙ্গের ১১ জেলার মানুষের ট্রেনে যাতায়াতে ভোগান্তি কমবে। সুবিধাভোগী ১১ জেলার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী বিভাগের বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ এবং রংপুর বিভাগের আট জেলা।
তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত আরও তিন কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করায় এদিকের ট্রেনগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু পার হয়ে সারাদেশের সঙ্গে চলাচল করতে পারবে।
আরও পড়ুন: ঢাকার সঙ্গে কমবে ১১২ কিমি দূরত্ব, বাঁচবে ৪ ঘণ্টা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পে যত সময়ক্ষেপণ হচ্ছে তত জটিলতা বাড়ছে। এর আগে ২০১৮ সালে অনুমোদনের সময় প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় পাঁচ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু এরপর সময় গেছে পাঁচ বছর। এখন এসব এলাকায় জমির দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। এরপর আবার ২০১৭ সালে পাস হওয়া ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল বিল-২০১৭’ আইনেও জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ দেড়গুণ থেকে বৃদ্ধি করে তিনগুণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মেগা এই প্রকল্পে দ্রুত কাজ এগিয়ে না নিলে সরকারি অর্থের অপচয় শুধু বাড়বেই।
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, এই রেলপথটি বগুড়া ও সিরাজগঞ্জবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প। জেলা প্রশাসন থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও প্রসার হবে। সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পে দুই ভাগে কাজ করবে ভারতের দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাইটস লিমিটেড ও আরভি অ্যাসোসিয়েটস আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড।
এফএ/এএইচ/এমএস