সীমানা সমস্যায় হবিগঞ্জের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা

সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন হবিগঞ্জ
প্রকাশিত: ০১:৩৬ পিএম, ০১ জুলাই ২০২৩

সীমানা চিহ্নিতকরণসহ নানা সমস্যায় আছেন হবিগঞ্জের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা। কখনো আবার বাইরে থেকে গিয়ে অনেকেই সেখানে প্রভাব খাটিয়ে অপকর্ম চালানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া বৃষ্টি এলেই ঘরে পানি পড়ে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে জেলাকে গৃহহীন মুক্ত করার অংশ হিসেবে গৃহহীনদের জন্য জেলায় তিন ধাপে ২ হাজার ৮৩টি ঘর সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৭৮৭টি, দ্বিতীয় ধাপে ৩৫৫টি এবং তৃতীয় ধাপে জেলায় ৯৪১টি ঘর হস্তান্তর করা হয়।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের আনন্দপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ১৩৫টি ঘর নির্মাণ করে গৃহহীনদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘরগুলোর রং নীল। পরবর্তীতে লাল রঙের আরও ১৮টি ঘর নির্মাণ করে দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘরগুলো সরকারি ভূমিতে নির্মিত হলেও আশ্রয়ণের মূল ভূমি চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে পাশের জমির মালিকরাও আশ্রয়ণ এলাকায় সরকারি জমি দখল করছেন। অনেক সময় বহিরাগতরাও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের নানাভাবে হয়রানি করেন। রাতে নানা অপকর্ম করার চেষ্টা চালান। কখনো আবার আশ্রয়ণের বন্ধ ঘরগুলোতে বহিরাগতরা রাতে মাদক সেবনসহ নানা অপকর্মের চেষ্টা করেন। এতে আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে।

আনন্দপুরে আশ্রয়ণের বাসিন্দা জাহেদা খাতুন বলেন, আমাদের সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। আমরা হাঁস, মুরগি পুষতে পারি না। একজনেরটা অন্যজনের জায়গায় গেলে নানা কথা বলে। বৃষ্টি এলে আমরা ঘরে ঘুমাতে পরি না। পানি ঢুকে যায়। বিছানা ভিজে যায়। ঘরে পানি উঠে যায়। দরজা, জানালা ভেঙে যাচ্ছে। আমরা অনেক আগে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেক ঘরের বাথরুমের দরজা নেই। একজনের টয়লেটের ট্যাংক অন্যজনের জায়গায় চলে গেছে। এ নিয়ে অনেক সময়ই ঝগড়া হয়।

আশ্রয়ণের বাসিন্দা নাছিমা খাতুন বলেন, বৃষ্টি এলেই ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। ঘরের বিছানা ভিজে যায়। টয়লেট ভরে যায়। ময়লা পানি ঘরে প্রবেশ করে।

লক্ষ্মী রাণী সরকার বলেন, আমাদের সরকার ঘর দিয়েছে। কিন্তু এ ঘরে থাকার উপায় নেই। বৃষ্টি হলে টয়লেটের পানি এসে ঘরে ঢোকে। এ ঘরে খাওয়া, থাকা অনেক কষ্টকর। এর মধ্যে জায়গা চিহ্নিত না হওয়ায় সামনে দিয়েও বের হতে পারি না, পেছন দিয়েও বের হতে পারি না। যেদিকেই যাই একেকজন আপত্তি দেয়।

মো. মোশাহিদ বলেন, আমাদের গুচ্ছগ্রামের সঙ্গে আশপাশের বাসিন্দাদের জমিজমা আছে। আমাদের জমিটা যদি শনাক্ত করে দেওয়া হয় তবে এটি আমাদের জন্য ভালো হবে। আবার স্থানীয় গ্রামবাসীর জন্যও ভালো হবে।

আশ্রয়ণের পাশের বাড়ির বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, আশ্রয়ণে যাদের সরকার জায়গা-জমি দিয়েছে তাদের জমি চিহ্নিত করে দেওয়া দরকার। যদি তাদের সীমানা ঠিক না করা হয় তবে এক সময় আমাদেরও অসুবিধা হতে পারে।

জেসমিন আক্তার বলেন, গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা আমাদের প্রতিবেশী। তাদের জমিজমা নির্ধারিত করে দেওয়া দরকার। না হলে একসময় এটি আমাদের যেমন অসুবিধা হতে পারে, তেমনি তাদেরও অসুবিধা হতে পারে।

আনন্দপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক যতীন্দ্র পাল বলেন, আমাদের একটি সীমানা নির্ধারণ করা দরকার। আশপাশে অনেক ব্যক্তি মালিকানার জমি আছে। এখন আমরা আমাদের সীমানা পাচ্ছি না। কতটুকু জায়গায় আমরা বসবাস করবো তা নির্ধারণ করার দাবি জানাই।

তিনি বলেন, আজ দুই বছর হয়ে গেছে আমরা এখানে আছি। কিন্তু এখনো জায়গা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি এলে অনেকেরই ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। অনেকের আবার টয়লেটের ট্যাংক ডুবে ঘরে ময়লা পানি চলে আসে।

প্রকল্পের সমিতির সভাপতি হিরা মিয়া বলেন, একজনের ঘরে অন্যজন থাকে। অনেকে বলে ভাইয়ের ঘরে বোন থাকছে। কিন্তু আমরা তো আসলে জানি না কে কার ঘরে থাকছে। এসব ঘরে প্রতিনিয়তই ঝগড়া হয়। বিচার করতে করতে আমরা হয়রান হয়ে যাচ্ছি। যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে কেউ চলে যায় তখন আমাদের কী হবে। এর দায়ভার কে নেবে? আমরা বলছি, যারা ঘর পেয়েছে তাদের বুঝিয়ে দিয়ে বাকিগুলো যেন তালা দেওয়া হয়। যেন বাইরের লোক এখানে এসে মাদক সেবন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে না পারে।

তিনি বলেন, আমাদের চারদিকে সীমানা নির্ধারণ করা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। এটির জন্যও আমরা বারবার বলছি। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকী যারা ঘর পেয়েছে তাদেরও ঘরের সীমানা নির্ধারণ করা নেই। আমাদের ঘরের দরজা জানালা ভেঙে যাচ্ছে। এগুলোর তালিকা দিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রায় ছয় মাস আগে একটি ঘরে সন্ত্রাসীরা প্রবেশ করে নেশা করছিল। সারারাত আমরা আতঙ্কে কাটাই। তারা আমাদের মারবে-কাটবে বলে হুমকি দেয়।

গোপায়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মন্নান বলেন, আশপাশের কিছু মানুষ আছে যারা এখানে কিছু প্রভাব খাটায়। আশ্রয়ণের লোকজন বাইরে থেকে এসেছে। তারা নিরাপদ নয়। আমি দাবি জানাই তাদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। যেন কেউ প্রভাব খাটিয়ে তাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে কোনো অপকর্ম না করতে পারে।

তিনি বলেন, তাদের জায়গা চিহ্নিত করার দরকার। এটিও যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, আশ্রয়ণের সীমানা চিহ্নিত করে কাজ করা হয়েছে। আর বাইরে থেকে কেউ যদি গিয়ে সমস্যা তৈরি করে সেটি কেউ জানায়নি। জানালে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে ভূমিহীনরা থাকছে। এরা তো তাদেরই প্রতিবেশী। একজন প্রতিবেশী যদি অন্যজনের সমস্যা করে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, তাদের জায়গা যেন দ্রুত চিহ্নিত করা হয় সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কেউ জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।