‘ছয় বছর আগে পদ্মা সেতু হলেই আমার লাবিব জীবিত থাকতো’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ১২:৩০ পিএম, ২৫ জুন ২০২৩
পদ্মায় স্পিডবোট ডুবে নিহত শিশু লাবিব

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে ২৫ জুন। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হয়েছে বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতু চালুর মধ্যদিয়ে। শুধু ভোগান্তি লাঘব নয়, ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এখন আর সেই ঝুঁকি নেই ভেবেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন পদ্মাপাড়ের বাসিন্দার।

তেমনই দুজন শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে মহিষার ইউনিয়নের বাসিন্দা হারুন হাওলাদার ও ডালিয়া বেগম দম্পতি। ২৫ জুন পদ্মা সেতুর প্রথম বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে। বর্ষপূর্তির এ খবর শুনে ৬ বছর আগে পদ্মা নদীতে স্পিডবোট ডুবে নিহত ছেলের কথা মনে করে চোখ ভিজে যায় তাদের। সেই সঙ্গে স্যালুট জানান স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ণের কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

জানা গেছে, ২০০৭ সালে ডালিয়া বেগম ও হারুন হাওলাদারের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা ইতালি চলে যান। সেখানে ২০০৮ সালে তাদের একটি ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। নাম রাখেন হাওলাদার লাবিব। পরে ২০১২ সালের শুরুর দিকে ইতালি থেকে স্ত্রী ডালিয়া ও ছেলে লাবিবকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন তিনি। ঢাকায় নিজেদের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন লাবিব ও তার মা ডালিয়া। লাবিব মিরপুর মনিপুরী স্কুলে ইংরেজি বিভাগে লেখাপড়া করতো।

২০১৭ সালের ৮ মার্চ হঠাৎ করে হারুন হাওলাদারের মা গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে ছোট্ট লাবিবকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে আসছিলেন হারুনের স্ত্রী। মিরপুর থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় সময় বাসে উঠে প্রথমে তারা মাওয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছান। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় কোনো লঞ্চ ছাড়ছিল না। দ্রুত বাড়িতে পৌঁছাতে বিকেল ৩টায় ১৬ জন যাত্রীর সঙ্গে একটি স্পিডবোটে ওঠেন। তাদের গন্তব্য ছিল মাঝিরঘাট। মাঝ নদীতে পৌঁছালে কালবৈশাখী ঝড়ে তাদের স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এসময় মা ডালিয়া বেঁচে গেলেও ডুবে যায় লাবিব।

আরও পড়ুন>> খুললো শত-সহস্র স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুয়ার

পরে পদ্মার মাঝে চরে ভেসে ওঠে লাবিবের মরদেহ। এরপর তাকে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাবিবের মৃত্যুর ৩ দিন পর স্ট্রোক করে মারা যান হারুনের মা। এরপর ওই হারুন ডালিয়া দম্পতির ঘর আলোকিত করে আরও একটি ছেলে সন্তান।

লাবিবের মা ডালিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভয়াবহ সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমার সোনার টুকরা ছেলে হারাইয়া আজকে আমি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যাই। পদ্মা সেতু দেখলেই আমার আমার ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। যদি পদ্মা সেতুটা আর ৫-৬ বছর আগেই হতো, তাহলে হয়তো আমার ছেলেকে হারাতে হতো না। সবচেয়ে বড় বিষয় আমার ছেলেকে নিলো আল্লাহ তায়ালা, কেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখলো?’

‘ছয় বছর আগে পদ্মা সেতু হলেই আমার লাবিব জীবিত থাকতো’

লাবিবের বাবা হারুন হাওলাদার

প্রাণপ্রিয় ছেলেকে হারিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি তিনি। বলেন, ‘শেখ হাসিনা একজন সফল প্রধানমন্ত্রী। আজকে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ পদ্মা সেতু হয়ে কী সুন্দর চলাফেরা করছে। গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছিল, আবার ২৫ জুন চলে আসছে। বলতে বলতে ১টি বছর পেরিয়ে গেলো। আজকে আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না- এ ভেবেই আমার খুব ভালো লাগছে।’

আরও পড়ুন>> আগামী জুনে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর যাবে ট্রেন

লাবিবের বাবা হারুন হাওলাদার বলেন, ‘আমি সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই এবং স্যালুট জানাই। ২৫ জুন দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রথম বর্ষপূর্তি। বর্ষপূর্তির কথা শুনে খুব আনন্দিত আমি। কিন্তু ছেলের কথা মনে করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি ন। আমি ইতালি প্রবাসী ছিলাম। সুখের সংসার ছিল আমার। ৬ বছর আগে আমার ছেলে লাবিবকে আমি হারিয়েছি। তবে সেদিন ফেরত পেয়েছিলাম স্ত্রীকে। এখন আমার ৫ বছরের আরেকটি ছেলে রয়েছে। আমি গত বুধবার ঢাকা থেকে আসলাম মাত্র ২ ঘণ্টায়। প্রতিনিয়ত আমি পরিবার নিয়ে ঢাকায় যেতে পারছি খুব আরামে। কিন্তু আজকে লাবিব নাই! পদ্মা সেতু দেখলেই মনে পড়ে আমার লাবিবের কথা।’

পদ্মা সেতু হওয়ার আগে পদ্মা নদীর বরিশাল, চাদপুর ও মুন্সিগঞ্জের লৌহজং, গজারিয়া অংশে অনেক লঞ্চডুবির দুর্ঘটনা ঘটতো। ২০১২ সালে শরীয়তপুর ১ লঞ্চ ডুবে শরীয়তপুরের ৩ বাসিন্দা নিহত হন। নিহতরা হলেন- মহিষার ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা লোকমার হাওলাদার, মেজু মোড়ল, লড়িয়ার গোলার বাজারের রহিম সরদার। নিহতদের পরিবার শোক কাটিয়ে উঠতে না পারলেও পদ্মা সেতু হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন তারা।

আরও পড়ুন>> প্রথম ৮ ঘণ্টায় পদ্মা সেতুতে ৮২ লাখ টাকা টোল আদায়

মহিষার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অরুন হাওলাদার বলেন, ‘২৫ জুন পদ্মা সেতুর প্রথম বর্ষপূর্তি দিন। আমাদের দক্ষিণবঙ্গ তথা শরীয়তপুরবাসীর আনন্দের দিন। তবে পদ্মা নদীতে কালবৈশাখী ঝড়ে স্পিডবোট ডুবে লাবিব মৃত্যুর ঘটনা আজও মনে পড়ে। আজকে দক্ষিণবঙ্গের মানুষকে সেই লঞ্চ আর স্পিডবোট খুঁজতে হয় না। সরাসরি ঢাকা থেকে বাস নিয়ে যার যার বাড়ি চলে আসতে পারেন। মহিষারে আমরা ছোট পরিসরে কেক কেটে পদ্মা সেতুর প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন করবো।

‘ছয় বছর আগে পদ্মা সেতু হলেই আমার লাবিব জীবিত থাকতো’

২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়। উন্মোচিত হয় যোগাযোগের নতুন দিগন্ত।

আরও পড়ুন>> পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ছে ১১১৮ কোটি টাকা

ওইদিন প্রথম যাত্রী হিসেবে টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে টোল দেন। এরপর তার গাড়িবহর সেতু উদ্বোধনের জন্য ফলকের স্থানে যায়। প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিরা গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে প্রথমে মোনাজাত করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মোনাজাত পরিচালনা করেন। দুপুর ১২টার একটু আগে সুইচ টিপে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন তিনি। এর মাধ্যমেই খুলে যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সড়ক পথের দ্বার।

পরদিন ২৬ জুন ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় আসতে দীর্ঘদিন যে অসহনীয় দুর্ভোগ ও কষ্ট ছিল তা সেদিন থেকেই দূর হয়েছে।

শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত দিয়ে উত্তাল পদ্মা নদী পার হতে যেখানে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো এখন সেই নদী পার হতে সময় লাগছে মাত্র কয়েক মিনিট।

ইএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।