জলের ‘পাগলা ঘোড়া’ ডাঙায় ঘুমায়
স্পিডবোট যাকে বলে জলের ‘পাগলা ঘোড়া’ নিশ্চল পড়ে আছে। নেই যাত্রীদের কোলাহল, পারাপারের দৌড়ঝাঁপ। মালিককেও খুঁজে পাওয়া দায়। প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের স্পিডবোটগুলোর ঠাঁই হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরার মঙ্গল মাঝির ঘাটে। লোকসানের ভার বইছেন মালিকরা। সেই সঙ্গে কর্মহীন হাজার হাজার স্পিডবোট চালক-কর্মচারী।
পুরোনো স্পিডবোট ঘাট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এক বছর হয়ে গেলো। একজন যাত্রীও আসে নাই এই ঘাটে স্পিডবোটে পারাপার হওয়ার জন্য। এই ঘাটে মোট ৩০টি স্পিডবোট যাত্রী পারাপারের কাজে দিনভর ব্যস্ত ছিল। প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার দেড় থেকে দু’শো যাত্রী ঢাকার উদ্দেশ্যে মাওয়া ঘাটে যেতেন। এখান থেকে স্পিডবোটে উঠলে ৫ থেকে ১৮ মিনিটে মাওয়া ঘাটের প্রান্তে পৌঁছানো যেত। এসব স্পিডবোট আর চলে না। পড়ে আছে ফেরি ঘাট ও লঞ্চ ঘাটের তীরে আর কিছু স্পিডবোট তালা লাগিয়ে তীরে নোঙ্গর করে রেখেছেন মালিকরা।
এই স্পিডবোটগুলোকে ঘিরে প্রায় ৫০ পরিবারের জীবন-জীবিকা চলতো। আজ সেই পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ স্পিডবোটের কর্মচারী এখন ঢাকায় অথবা ফুটপাতে বা দোকানে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। অন্যদিকে, স্পিডবোট মালিকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। কেননা প্রত্যেকটা স্পিডবোটই নতুন কন্ডিশনের। এক একটা স্পিডবোটের দাম ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এসবের ইঞ্জিনসহ পার্স সব খুলে নিয়ে গেছেন বোট মালিকরা। শুধু বডি পড়ে আছে ঘাটে।
আরও পড়ুন> সংকট আর শঙ্কার পদ্মা পাড়ি এখন ভয়হীন
শাহীন সরদার নামে স্পিডবোটের এক কর্মচারী বলেন, আমরা তখন দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার করতাম। এখন স্পিডবোট বন্ধ থাকায় দৈনিক কোনো কাজ নেই। শরীরটাও বেশি ভালো না। মাঝে মাঝে রাজমিস্ত্রির কাজে যাই। কোনো রকম সংসার চালাচ্ছি। আর এখন তো পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এক বছর হয়ে গেলো। তবে আগামী মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতে যাবো। পদ্মা সেতু না হলে কি তা পারতাম, ১ ঘণ্টায় সেখান থেকে আসতে পারবো। আর প্রতিদিন সকালে যেতে পারবো। পদ্মা সেতু করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
সরেজমিনে দেখা যায়, শরীয়তপুরের মাঝির ঘাটের স্পিডবোটগুলোর জীর্ণদশা। জানতে চাইলে ঘাটের সুপারভাইজার তাজেল মাদবর বলেন, এ ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম দীর্ঘদিন। ব্যস্ততম একটি ঘাট ছিল। এখন এ ঘাটে আর কোনো যাত্রী নেই। তাই বোটের বডিগুলো ফেলে রাখছে মালিকরা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই ঘাটের এমন দশা। বোটের দামি জিনিস হলো ইঞ্জিন। সেগুলো মালিকরা খুলে নিয়ে গেছে। অনেক মালিক চলে গেছেন ঢাকায়। অনেকে বেছে নিয়েছেন বিকল্প ব্যবসা। আবার কোনো বোট মালিক বিদিশে চলে গেছেন। আজকে একবছর হয়েছে আমি বেকার হয়ে পড়ে আছি।
আরও পড়ুন> পদ্মা সেতুর সুফলে বদলে গেছে মোংলা বন্দর
তাজেল মাদবর বলেন, বেকার হয়েও ভালো আছি। কারণ প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে আমাদের দক্ষিণবঙ্গকে একটি দেশের বৃহত্তর উপহারটি দিয়েছেন। এই কারণে আমাদের এলাকার জমির দাম ৩ গুণ বেড়ে গেছে। জাজিরার মানুষ কর্মহীন নেই বললে চলে। কারণ এখানে মিল, কারখানার জন্য জমি কিনছে অনেকে। তাই আমরা ভালো আছি। আমার দুটি বোট আছে যদি কেউ কিনতে চায় আমি কম দামেই বিক্রি করে দেবো।
মনির মাদবর নামে স্পিডবোটের এক মালিক বলেন, আমার মাঝির ঘাটে ২টা স্পিডবোটের বডি পড়ে আছে। ইঞ্জিনগুলো বাড়িতে নিয়ে এসেছি। কারণ এর আগে গত ছয় মাস আগে রাতে স্পিডবোট নিয়ে হামলা করেছিল একদল ডাকাত। আসলে আমরা কি পেলাম আর কি হারাইলাম এইটা যদি বিবেচনা করি তাহলে বলতে গেলে অনেক পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে আমাদের হয়তো এই ব্যবসা বন্ধ! কিন্তু আমরা এখন পরিবহন ব্যবসা ধরবো চিন্তা করে রেখেছি। তবে স্পিডবোটগুলো কোথাও বিক্রি করতে পারছি না। কারণ সেতুর কারণে আশপাশের ঘাটগুলোও মরে গেছে। একটা পুরোনো স্পিডবোট কিনতে গেলেও ৮ লাখ টাকার দরকার। তাই এত দামে কেউ কিনতে চায় না। শখের বসে কেউ কিনতে আসলে দাম বেশি বলে না তাই বিক্রিও করি না। তবে আমরা যারাই আছি এগুলো ক্রেতা পেলে বিক্রি করে দেবো।
আরও পড়ুন> জীবনে গতি ফিরিয়েছে পদ্মা সেতু
নাওডোবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আলতাব খান বলেন, এই ঘাট এক সময় ব্যস্ততম ঘাট ছিল। দক্ষিণবঙ্গের বড় পাওয়া পদ্মা সেতু। সেতু উদ্বোধনের এক বছর হয়ে গেলো আজ। স্পিডবোটের মালিকরা একেক জন একেক ব্যবসা করছে এখন। আমি মনে করি এই পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পরম পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। দেশের বৃহত্তম বড় প্রকল্প আমাদের এই জাজিরাতেই হয়েছে এখন। একটি লঞ্চ ঘাট, একটি ফেরি ঘাট, একটি স্পিডবোট ঘাট চলে গেলে কী হবে এর থেকে ১০ গুণ বেশি ঘাটের সুবিধা পাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ।
এসএনআর/এমএস