সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা এখন ৫ ঘণ্টার দূরত্ব
এক বছর আগেও সাতক্ষীরা থেকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনে একমাত্র বাধা ছিল পদ্মা নদী। পদ্মা সেতু চালুর পর আমূল পরিবর্তন এসেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সেতু চালুর আগে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যেতে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। ঘন কুয়াশা, ঝড়বৃষ্টি বা যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যেতো।
দীর্ঘ ভোগান্তির ফেরিঘাটের সেই জ্যামের চিত্র এখন শুধুই স্মৃতি। এখন পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায় ২৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় পৌঁছানো যায়।
পরিবহন মালিকদের দাবি, গত একবছরে পদ্মা সেতু হয়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা রুটে বিলাসবহুল বাসসহ নতুন পরিবহন বেড়েছে দুইশর বেশি। বেড়েছে যাত্রীও। বর্তমানে সাতক্ষীরা-ঢাকা রুটে সরাসরি চলাচল করছে তিন শতাধিক বাস। সাতক্ষীরা-ঢাকা রুটে একসময় শুধু সন্ধ্যা ও সকালে বাস চলাচল করলেও এখন প্রতি ঘণ্টায় বাস চলাচল করছে। এতে ভোগান্তি কমেছে এখানকার যাত্রীদের।
তবে মালিক সমিতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সাতক্ষীরার অনেক পরিবহন এখনো গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা সেতু যেতে পারছে না। তাদের চলাচল করতে হচ্ছে যশোর, নড়াইলের ওপর দিয়ে কালনা সেতু হয়ে। এজন্য ঢাকায় যেতে এক ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে। সমস্যা সমাধান হলে এ রুটের যাত্রীরা আরও ভালো সেবা পাবেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাতক্ষীরার বাসিন্দা আসিফ মাহমুদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সাতক্ষীরা থেকে বাস ছাড়া বিকল্প কোনো মাধ্যমে ঢাকায় যাতায়াতের সুযোগ নেই। এজন্য বাসই আমাদের একমাত্র ভরসা।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর আগে ফেরিঘাটে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হতো। বর্তমানে সেই ভোগান্তি নেই। পদ্মা সেতু চালুর পর এখন চার-পাঁচ ঘণ্টায় সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় পৌঁছানো যায়। আমার মতো যারা ঢাকায় চাকরি করেন তাদের অনেকে এখন সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বাড়ি আসেন আবার রোববার ঢাকায় পৌঁছে অফিস করতে পারেন।’
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের গ্রাম সুন্দরবনের পাশে প্রত্যন্ত এলাকায়। এখান থেকে একসময় চাকরির পরীক্ষা, চিকিৎসা বা অন্য কোনো কাজে ঢাকা যেতে চাইলে দুদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হতো। বর্তমানে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় যেতে সময় লাগছে মাত্র সাত ঘণ্টা। রাতের গাড়িতে ঢাকায় গিয়ে সারাদিনের কাজ শেষ করে পরের রাতেই আবার বাড়ি ফেরা যায়। পদ্মা সেতু আমাদের অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে।’
সাতক্ষীরা শহরের বাসিন্দা আজিবার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় যাওয়ার ভোগান্তির কারণে আগে চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরার মানুষ কলকাতায় যেতেন। এখন সেই দিন বদলে গেছে। পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকায় যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। এখন সকালে ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে রাতে সাতক্ষীরায় ফিরে আসা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে সবাই ঢাকায় থাকে। আগে ফেরি পারাপারের কারণে তাদের অনেক সমস্যা হতো। পদ্মা সেতু চালুর পর তারা এখন মন চাইলেই বাড়ি চলে আসে। সাতক্ষীরা থেকে এখন আর ঢাকা খুব দূরত্বে মনে হয় না।’
বাসচালক আব্দুল আলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেরিঘাটে জ্যামে বসে থেকে কত রাতদিন যে কেটে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। এর ওপর ফেরিতে ওঠানামা করার সময় অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাড়ির টায়ার, পার্টস, বডি নষ্ট হয়েছে। অনেক সময় গাড়ি নদীতে পড়ে গেছে। অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়। এখন অনেক আরামে গাড়ি চালাই।’
তিনি বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে আর পদ্মা সেতু হয়ে দ্রুততম সময়ে ঢাকায় যেতে পারছি। আগে একটি ট্রিপ নিয়ে একদিন লাগতো। এখন দিনে দু-তিনটি ট্রিপ দিতে পারি। এ কারণে আমাদের আয়ও বেড়েছে।’
পদ্মা সেতুর কারণে বর্তমানে সাতক্ষীরা-ঢাকা রুটে যাত্রী ও গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান সাতক্ষীরা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি তাহমিদ চয়ন।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাউন্টার ও গাড়িগুলোতে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বেড়েছে। সাতক্ষীরার পরিবহন মালিক ১২ জন। বর্তমানে আমাদের গাড়ির পরিমাণ ১১০টি। এছাড়া জেলার বাইরে থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ২০০ গাড়ি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে নিয়মিত চলাচল করছে। এ সেক্টরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরার পরিবহন মালিকদের অনেক গাড়ি এখনো খুলনা, গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে পারছে না। তাদের যশোর, নড়াইল কালনা সেতু হয়ে পদ্মা সেতু পার হতে হচ্ছে। এজন্য সময় কিছুটা বেশি লাগছে। খুলনা ও গোপালগঞ্জ বাসমালিক সমিতির নেতারা একটু ছাড় দিলে এ রুটে বাস চলাচলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। যাত্রীসেবার মানও বাড়বে।
সাতক্ষীরা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, রুট পারমিট ও সাতক্ষীরার মালিকদের বাস চলাচল নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। গোপালগঞ্জ বাস মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে।
আহসানুর রহমান রাজীব/এসআর/এমএস