পদ্মা সেতুর সুফলে বদলে গেছে মোংলা বন্দর
পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে নতুন করে মোংলা বন্দরসহ আশপাশ এলাকাজুড়ে শুরু হয়েছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। বন্দরের আশপাশে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। এতে সেতুর ওপর যেমন বেড়েছে যান চলাচল, তেমনি এ বন্দরে কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে। গতি এসেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। সেতুর সুফলে এ বন্দর হয়ে গার্মেন্টস শিল্প যাচ্ছে ইউরোপ ও পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে।
তবে এ চাপ সামলাতে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে বন্দর ব্যবহারকারীদের জরুরি বার্তা সেবা বা ভ্যাসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের উন্নয়ন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, কনটেইনার ইয়ার্ড সংস্কার, চ্যানেলের ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নসহ নানা ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
গত বছরের ২৫ জুন ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়। এরপর এ সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয় ২৬ জুন। ফলে দেশের অর্থনীতিতে সূচনা হয়েছে নতুন এক অধ্যায়ের। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে খুলে গেছে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। পাল্টে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানও।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ছে ১১১৮ কোটি টাকা
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপসচিব (বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগ) মো. মাকরুজ্জামান জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানকে মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে এ বন্দর। এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে মোংলা বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিও শুরু হয়েছে। আগে স্বল্প পরিসরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হলেও সেতু চালুর পর থেকে তার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, সেতুর চালুর পর মোংলা বন্দর থেকে গত বছরের ৬ জুন প্রথম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে। এরপর ৭ জুলাই দ্বিতীয় চালান, চলতি বছরের ৫ মে তৃতীয় চালান, ৬ জুন চতুর্থ চালানের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এছাড়া ডেনমার্ক ও গ্রেট ব্রিটেনেও গার্মেন্টস পণ্য গেছে সেতু চালুর পর।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা জহিরুল হক জানান, পদ্মা সেতুকে ঘিরে মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নের জন্য নতুন নতুন অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বন্দরের ড্রেজিং ব্যবস্থা উন্নয়নে ৭৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় পশুর চ্যানেলের জয়মনিরঘোল থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হচ্ছে। চ্যানেলটির ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে ৯ দশমিক ৫০ মিটার থেকে ১০ মিটার গভীরতার কনটেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারবে।
আরও পড়ুন: আগামী জুনে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর যাবে ট্রেন
বন্দরের কনটেইনার রাখার স্থান বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ১ হাজার ৫০টি কনটেইনার ধারণক্ষমতার কনটেইনার ইয়ার্ড। বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজে ও বন্দর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। পাশাপাশি বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য জরুরি বার্তা সেবা কার্যক্রমের উন্নয়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ করা প্রতিটি জাহাজ তদারকির পাশাপাশি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন বন্দরের এ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্দরে চলাচলকারী বিভিন্ন বাল্কহেড, কনটেইনার, ট্যাংকার ও অন্যান্য জলযান থেকে নিঃসৃত তেল এবং পেট্রোলিয়াম বর্জ্যসহ অন্যান্য আর্বজনা সংগ্রহ করা সহজ হবে। একইসঙ্গে পশুর চ্যানেল ও বন্দরের আশপাশের নদ-নদীতে বিভিন্ন জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেল অপসারণ করাও সহজ হবে। এতে মোংলা বন্দর এলাকায় সামুদ্রিক দূষণ কমানোসহ বন্দর ও চ্যানেল এলাকার পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী জানান, পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে মোংলা বন্দরের উন্নয়নে বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন্দর উন্নয়নে হাতে নেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প।
আরও পড়ুন: ৭০০ কোটি ছাড়ালো পদ্মা সেতুর টোল আদায়
তিনি বলেন, আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় ১২টি কম্পোনেন্ট থাকবে। এগুলো হচ্ছে বন্দর জেটিতে ১ ও ২ নম্বর কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ইয়ার্ড নির্মাণ, কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ, ইয়ার্ড শেড, নিরাপত্তা দেওয়াল, অটোমেশন ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ, সার্ভিস ভেসেল জেটি শেড ও অফিস নির্মাণ, বন্দর ভবন (প্রশাসনিক) সম্প্রসারণ, এমপিএ টাওয়ার, পোর্ট রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স কমিউনিটি সুবিধাদি নির্মাণ, ইকুইপমেন্ট ইয়ার্ড, ইকুইপমেন্ট শেড ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ একটি পুল নির্মাণ, সিগন্যাল রেড ক্রসিং ও ওভারপাস নির্মাণ, বিনোদন ব্যবস্থাসহ বাঁধ নির্মাণ এবং পাঁচটি হারবার ক্রাফট ক্রয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সময় সাশ্রয় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা এখন মোংলা বন্দর ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বর্তমানে মোংলা বন্দরের নিজস্ব জমিতে ১১টি এলপিজি কারখানা, পাঁচটি সিমেন্ট কারখানাসহ আরও ১০টি শিল্প-কলকারখানা রয়েছে। বন্দর এলাকায় ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেপজা) প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানার কাঁচামাল মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে আসছে। ফলে বাণিজ্যিক স্বার্থেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে জানান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী।
আরও পড়ুন: পাটুরিয়া-গোয়ালন্দে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু
বন্দরের সুবিধাদি বাড়ানোর জন্য ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে মোংলা-খুলনা রেললাইন, রেলসেতু ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ায় মোংলা বন্দরকেন্দ্রিক দেশের শিল্প-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে মোংলা বন্দরের প্রতি।
মোংলা বন্দর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, মোংলা বন্দর ঘিরে বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা সেতু থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত ছয় লেনবিশিষ্ট সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন, মোংলা ইপিজেড সম্প্রসারণ, স্পেশাল ইকোনমি জোন স্থাপন, রূপসা নদী ও মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত জোট সরকার এ বন্দরকে ধ্বংস করতে কোনো উন্নয়ন করেনি। জোট সরকার দুর্নীতি করে এ বন্দরকে শেষ করে দিয়েছিল। ওইসময় বন্দরে কোনো জাহাজ আসতো না। মোংলা মৃত বন্দরে পরিণত হয়েছিল। সেখান থেকে বর্তমান সরকার এ বন্দরকে টেনে তুলেছে। বন্দরকে ঘিরে এখন চারদিকে শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া।
মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ও মোংলা বন্দর বার্থ শিপ অপারেটর আসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মোস্তাক আহম্মেদ মিঠু, সদস্য এইচ এম দুলাল, জিসান রহমান ভুট্টো ও মসউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব এখন ১৭০ কিলোমিটার। যেখানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে।
এসআর/এমএস