কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট
চা বাগান এখন চাষিদের গলার কাঁটা
পঞ্চগড় উপজেলা সদরের মাহানপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র কৃষক সোহেল প্রধান। তিনি চা চাষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দেড় বিঘা জমিতে চা বাগান করেছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অব্যাহত লোকসানে চা বাগান কেটে এবার তিনি ভুট্টা আবাদ করে ২০ হাজার টাকা লাভ করেছেন।
সোহেল বলেন, আমি ঠিক কাজটিই করেছি। অনেকেই এখন বাগান কেটে অন্য ফসল আবাদের কথা ভাবছেন।
সোহেলের মতো এমন অনেক কৃষক তিন ফসলি জমিতে চা আবাদ করে বছরের পর লোকসান গুনছেন। উপযুক্ত দাম না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন ক্ষুদ্র চা চাষিরা।
পঞ্চগড়ের সমতল জমিতে প্রায় দুই যুগ আগে (২০০০ সালে) বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চা চাষে বিপ্লব ঘটে উত্তরের এই জেলায়। অর্থনীতির বড় একটা অংশের যোগান আসতে শুরু করে জেলার চা চাষ থেকে। দীর্ঘদিনে জেলার প্রায় ১২ হাজার ৭৯ একর জমিতে গড়ে ওঠে ছোট বড় আট হাজারের বেশি চা বাগান।
বর্তমানে জেলায় বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের নিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা নয়টি, অনিবন্ধিত ২১টি, নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান দুই হাজার ৫৩টি এবং অনিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা আট হাজার ৩৫৫টি। এসব চা বাগান থেকে পাতা ক্রয় করে চা উৎপাদনে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এ পর্যন্ত ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।
এরইমধ্যে চা উৎপাদনে দ্বিতীয় চা অঞ্চল হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। গত বছর জেলায় এক কোটি ৭৭ লাখ ৭৯ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়। যার বাজার মূল্য ২৬০ কোটি টাকা। গেল বছর দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের ১৯ শতাংশ পঞ্চগড়ে উৎপাদিত হয়েছিল। এবার দুই কোটি কেজি চা উৎপন্ন হবে বলে আশা করছেন পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডসহ চা সংশ্লিষ্টরা। সবদিক বিবেচনায় পঞ্চগড় এখন দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল। চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পর পঞ্চগড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র। এর প্রস্তুতিও প্রায় শেষ দিকে।
এদিকে ক্ষুদ্র চা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম দিকে কারখানা মালিকরা স্থানীয় কৃষকদের চা পাতা উৎপাদনে উৎসাহিত করতে নানান কৌশল শুরু করেন। শুরুর দিকে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা কিনেছিল এসব চা কারখানা। চা চাষিদের চা পাতা কেনার পর তাদের মিষ্টির প্যাকেট দেওয়া হতো সম্মান দেখিয়ে। কারখানা মালিকদের এমন প্রলোভনে পড়ে স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষকরা তাদের তিন ফসলি জমিতে দীর্ঘমেয়াদী চা চাষ শুরু করেন। ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত জমিতেও চা চাষ শুরু করেন কৃষকরা।
কিন্তু বর্তমানে সার, সেচ, কীটনাশকসহ মজুরি বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও সেই হিসাবে চা পাতার দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। সর্বশেষ জেলায় কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজি চা পাতার মূল্য ১৮ টাকা নির্ধারণ করে। চলতি চা মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ টাকা কেজি দরেই পাতা কিনছেন কারখানা মালিকরা।
তবে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে ১৮ টাকা কেজি দরেও পাতা বিক্রি করতে পারছেন না চাষিরা। সিন্ডিকেটের কৌশল হিসেবে কারখানা মালিকরা বিভিন্ন অজুহাতে পালাক্রমে তাদের কারখানা বন্ধ রাখেন। সময়মতো চাষিরা তাদের বাগান থেকে চা পাতা আহরণ করতে না পারায় চা গাছ বড় হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন কারখানায় চা পাতা বিক্রির জন্য তাদের ধর্ণা দিতে হয়। এক পর্যায়ে কোনো এক কারখানায় সিরিয়াল পেলেও চার থেকে ছয় পাতার বিপরীতে বাধ্য হয়ে তাদের বড় আকারের ৮ থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত কর্তণ করতে হয়। আর এই অজুহাতে কারখানা মালিকরা নির্ধারিত ১৮ টাকা দাম দিলেও মোট ওজন থেকে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করে চা চাষিদের মূল্য পরিশোধ করেন। এতে চাষিরা কেজি প্রতি মূল্য পান মাত্র ৭ থেকে ৯ টাকা। অথচ প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদন করতে তাদের খরচ হয় ১৫ থেকে ১৮ টাকা। সেই হিসাবে কেজি প্রতি তাদের লোকসান গুণতে হয় ৮ থেকে ১০ টাকা।
বর্তমানে ক্ষুদ্র চা চাষিদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে চা চাষ। লাভের আশায় গম, ভুট্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে দীর্ঘমেয়াদী চা চাষ করায় বাগান কেটে অন্য ফসলেও যেতে পারছেন না তারা। এ নিয়ে স্থানীয় চা চাষিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে চাষিদের কাছ থেকে কৌশলে কম দামে কেনা কাঁচা চা পাতা থেকে উৎপাদন বেশি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন কারখানা মালিকরা।
তেঁতুলিয়া উপজেলার চা চাষি মোকছেদ আলী বলেন, বাজারে তৈরিকৃত চায়ের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। অথচ কাঁচা চা পাতার দাম কমছে। পঞ্চগড়ের সমতলে চা শিল্প ধ্বংস করার জন্য কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। আমার মতো অনেক চাষির চা চাষ এখন গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। কারখানা মালিকদের প্রলোভনে পড়ে তিন ফসলি জমিতে দীর্ঘমেয়াদী চা চাষ করে এখন না পারছি বাগান কেটে ফেলতে, না পারছি অন্য ফসল করতে।
কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি ও স্থানীয় চা চাষি আব্দুল লতিফ তারিন বলেন, তেঁতুলিয়া উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ চা চাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে লোকসান হওয়ায় তারা হতাশায় ভুগছেন। কারখানা মালিকরা দাম কমার পেছনে বড় পাতাকে দায়ী করছেন। কিন্তু তারা কম দাম ও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই বড় পাতা দিয়ে চা উৎপাদন করে বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন বলেন, কারখানা মালিকদের কারণে পঞ্চগড়ের চা শিল্পে এমন সংকট বিরাজ করছে। আমরা এখানে একটা সরকারিভাবে চা কারখানা স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি করে আসছি। তবে জেলায় নিলাম কেন্দ্র চালু হলে আশা করছি এই অবস্থার নিরসন হবে।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃষিবিদ আমির হোসেন বলেন, কারখানা মালিকরা কোনো নিয়মনীতি না মেনে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কারখানা বন্ধ এবং চালু রাখছেন। এজন্য সময়মতো চাষিরা কারখানায় চা পাতা প্রদান করতে পারছেন না। আবার দেরি করলে গাছ বড় হয়ে যায়। তখন বড় পাতার অজুহাতে আবার ওজন কর্তণ করেন। তাদের ইচ্ছামতো দরে চা পাতা কিনছেন কারখানা মালিকরা। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি।
তবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করে তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা জটিলতায় অনেক সময় বিভিন্ন চা কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন মালিকরা। কারখানার চলতি মৌসুমে খরার কারণে শুরু থেকে পাতা পাওয়া যায়নি। এখন সব চাষি একসঙ্গে পাতা নিয়ে আসছেন। আমাদের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কিনতে পারছি না। নির্দিষ্ট আকারের পাতা দিলে ১৮ টাকা দরেই কেনা হয়। পাতা বড় হলে ওজন কর্তণ করা হয়।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, চা সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে বৈঠকের মাধ্যমে কাঁচা পাতার মূল্য ঠিক করা হয়েছিল। চা নিলাম কেন্দ্রের দর বিশ্লেষণ করে কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তবে কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে চা পাতার কম দাম এবং ওজন কর্তন করে দাম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ নিয়ে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এখানে চা চাষ শুরু হয়। পঞ্চগড় এখন দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল। শিগগির এখানে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্রও চালু হবে। নিলাম কেন্দ্র চালু হলে আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।
এফএ/এমএস