খুলনা সিটি নির্বাচন
ভোটের সমীকরণে এগিয়ে নৌকার খালেক
রাত পোহালেই খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনের ভোট। শেষ সময়ে এসে নগরীর ভোটাররা মেলাতে শুরু করেছেন অনেক কিছুর হিসাব। কাকে ভোট দিলে কী হবে, তা ভাবছেন তারা। বেহাল সড়ক আর ড্রেনের কাজ শেষ হতে কত বছর লাগবে, এসব নিয়েই আলোচনা এখন সর্বত্র।
এতসব আলোচনার মধ্যেও সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেককে এগিয়ে রাখছেন ভোটাররা। তবে জয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও চুপ করে বসে থাকতে পারছেন না তিনি। নগরীর উন্নয়নের শেষ কাজটুকু সম্পন্ন করতে তিনিও এবার জোরেশোরেই ভোট চেয়েছেন। ছুটেছেন নগরীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায়। চেষ্টা করেছেন সব ভোটারের হাতে লিফলেট তুলে দিতে।
শুধু তিনিই নয় অন্য দলের মেয়র প্রার্থীরাও ঘাম ঝরিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরে খুলনার কী কী উন্নয়ন হয়নি, সুপেয় পানির সমস্যা, জলাবদ্ধতাসহ, অনুন্নত সড়ক যোগাযোগের কারণে নগরবাসীকে কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এসব প্রাধান্য পেয়েছে তাদের প্রচারণায়। মেয়র প্রার্থীদের অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীর চেয়ে বেশী বরাদ্দ দিয়েছেন খুলনায়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এখানে হয়নি।
কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এবারের কেসিসি নির্বাচনের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক (নৌকা), জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুল ইসলাম মধু (লাঙল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আব্দুল আউয়াল (হাতপাখা), স্বতন্ত্রপ্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান (দেওয়াল ঘড়ি) ও জাকের পার্টির এস এম সাব্বির হোসেন (গোলাপ ফুল)।
ভোটাররা বলছেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত। গত কয়েকটি নির্বাচনের ভোটপ্রাপ্তির ফলাফল বিশ্লেষণ করেই তারা এমনটা ধারণা করছেন। বিএনপি ছাড়া মেয়র পদে অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২০ হাজার ভোটও পাননি। সেখানে তালুকদার আব্দুল খালেক একাই পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯০২ ভোট। এছাড়া বর্তমানে আওয়ামী লীগের সমর্থক আরও বেড়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এবার নগরীতে ৪২ হাজার ৪৩৬ জন নতুন ভোটার হয়েছেন। নতুন এই ভোটাররা জীবনে প্রথমবার ভোট দেবেন। সেই ভোটের অর্ধেক ভোটও যদি আওয়ামী লীগের প্রার্থী পান তাহলে তাহলে তালুকদার আব্দুল খালেকের ভোট দুই লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার শুরুতে অনেকেই তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আব্দুল আউয়ালকে ভেবেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেবেন না। তারা হয়তো ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আব্দুল আউয়ালকে ভোট দেবেন। গত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এক লাখ ৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর ভোটও পেয়েছিলেন। এই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিরোধ রয়েছে ইসলামী আন্দোলনের। ফলে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ভোট দেবেন না ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে। আবার এবারের নির্বাচনে বিএনপির ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ আহ্বান জানানো হয়েছে। ফলে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী যদি বিএনপি বা জামায়াতের ভোট না পান তবে তাদের নিজেদের ভোট নিয়ে খুব একটা সুবিধায় থাকতে পারবেন না বলে মনে করছেন ভোটাররা।
নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার শফিকুল ইসলাম বলেন, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু। সেই নির্বাচনে মঞ্জু ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। তখন বিএনপির সঙ্গে জামায়াত এবং অন্য দল ছিল। কিন্তু তাদের সম্মিলিত ভোটও খালেককে হারাতে পারেনি। এবার তো বিএনপি নেই। আছে ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টির প্রার্থীরা। গত নির্বাচনে তাদের সবার ভোট একত্রে ২০ হাজারও হয়নি। সেই সময়ে বিএনপি এবং অন্য দলের ভোট মিলিয়েও তা এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি হয়নি। কিন্তু তালুকদার খালেক পেয়েছিলেন এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি ভোট।
তিনি আরও বলেন, এবার তো নতুন ভোটার হয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। সেই ভোটের অধিকাংশই পাবেন তালুকদার আব্দুল খালেক।
নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ ভোটার ইজিবাইকচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, গতবার সব ভোট মিলেও তালুকদার খালেকের কাছে যেতে পারেনি। এবার তো বিএনপি নেই। ফলে খালেকের জয় নিশ্চিত।
খুলনা সিটির মধ্যে শ্রমিকঘন এলাকা হিসেবে পরিচিত নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ড। সেখানকার শ্রমিক নেতা শামিম হোসেন বলেন, বিএনপি না থাকায় তালুকদার আব্দুল খালেকের বিজয়ী হতে কোনো বাঁধা নেই। তার জয়টা এখন সময়ের ব্যাপার। কারণ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থী এখন খুলনায় নেই।
ভোটের প্রচারণার সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেছেন, নৌকায় ভোট দিন, শেখ হাসিনা আপনাদের স্মার্ট খুলনা উপহার দেবে। আগামী প্রজন্মের জন্য খুলনা হবে স্মার্ট নগরী। সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি খুলনাকে উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অর্থায়ন করছেন। খুলনায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ডেন্টাল কলেজ, ক্যানসার ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল আইটি পার্কসহ অসংখ্য উন্নয়ন করেছেন। আগামীতেও এই খুলনায় যুব সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ করবেন। যা এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনায় রয়েছে। আপনারা খুলনার উন্নয়নের স্বার্থে নৌকায় ভোট দিন।
এদিকে, ভোটের হিসাব-নিকাশে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও গত পাঁচ বছরে খুলনার মানুষের ভোগান্তির কথা তুলে ধরতে একেবারেই কুণ্ঠাবোধ করছেন না জাতীয় পার্টির প্রার্থী এস এম শফিকুল ইসলাম মধু। নগরীর বড় বড় সমস্যার মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন ও সুপেয় পানির সংস্থান করতে না পারা, সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করতে না পারার মতো বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরছেন জনগণের সামনে।
একইভাবে বলছেন, ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মো. আব্দুল আউয়াল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান। তারাও নগরীর উন্নয়নে বিগত সময়ের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরে তা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন।
সোমবার (১২ জুন) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন, সাধারণ ৩১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সিটি করপোরেশনে ভোটার রয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। ২৮৯টি ভোটকেন্দ্রের ১ হাজার ৭৩২টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ভোটকেন্দ্র সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য মোট ২ হাজার ৩১০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ এরইমধ্যে শেষে হয়েছে।
এমআরআর/জেআইএম