বরিশাল সিটি নির্বাচন
বিএনপির ভোটারদের দিকে তাকিয়ে নৌকা-লাঙ্গল-হাতপাখা
বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের দিকে তাকিয়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থীরা। এমনকি বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপনও বিএনপির ভোট প্রত্যাশা করছেন।
শনিবার (১০ জুন) দুপুর ২টায় বরিশাল প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে বিএনপির ভোট পাওয়ার আশার কথা জানান স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী রুপন।
রূপন বলেন, আমার বাবা বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত আহসান হাবিব কামাল আমৃত্যু বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তাই বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের ভোট আমি পাবো বলে আশা করি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, বরিশালে বিএনপির বিশাল একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। এরই সূত্র ধরে ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি এখানে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
সেই হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মজিবুর রহমান সরোয়ার ৪২ হাজার ৬২১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রার্থী আওয়ামী লীগের এনায়েত পীর পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ২৬৫ ভোট। শুধু তাই নয়, ওই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল পেয়েছিলেন ২০ হাজার ২৪৮ ভোট। এবাদুর রহমান চাঁন পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৮৫৬ ভোট। বিএনপির তিন নেতার প্রাপ্ত সম্মিলিত ভোট ছিল ৭৬ হাজার ৭২৫। ফলে আওয়ামী লীগের দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পান বিএনপি নেতাকর্মীরা।
২০০৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট। তখন মাত্র ৫৮৪ ভোটের ব্যবধানে বিজীয় হন তিনি। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিএনপির তিন প্রার্থী (সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, আহসান হাবিব কামাল ও এবাদুর রহমান চাঁন) পান ৯২ হাজার ২৫৪ ভোট।
২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল ৮৩ হাজার ৭৫১ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ পেয়েছিলেন ৬৬ হাজার ৭৪১ ভোট।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এক লাখ ৯ হাজার ৮০৩ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ওই নির্বাচনে বিএনপির মজিবুর রহমান সরোয়ার পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৪১ ভোট। এই নির্বাচনকে ‘রাতের আঁধারের’ নির্বাচন বলে দাবি করেছিল বিএনপি।
এবার খোকন সেরনিয়াবাতের নৌকার বিরুদ্ধে তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন সেই হিসাব এখন বিএনপির ভোটাররাই ঠিক করবেন। তবে নৌকার বিরুদ্ধে থাকা তিন প্রার্থীই বলছেন তারা বিএনপির ভোট পাবেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে যাবেন এবং হাতপাখার পক্ষেই ভোট দেবেন। কারণ বর্তমান সরকার পতনের আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির মতো ইসলামী আন্দোলনও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুক্তিতে তারা (বিএনপি কর্মী-সমর্থক) আমাকে ভোট দেবেন। কারণ তাদের কোনো প্রার্থী নেই, তারা নৌকায় কখনোই ভোট দেবেন না।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু তাদের অনেক ভোট রয়েছে। ওই দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জাতীয় পার্টিকে ভোট দেবেন এটাই আমার আশা। কারণ জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ নেই। তাই আমরা বিএনপির ভোটারদের ভোট আশা করতেই পারি।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকার প্রতি মানুষের কতটুকু ভালোবাসা আছে সেটা বরিশালবাসী ভালো জানেন। হাতপাখা বরিশাল সদরের চরমোনাই ইউনিয়নে ২১ বছর ধরে চেয়ারম্যান থাকলেও চরমোনাইয়ের কোনো উন্নয়ন করেনি, যা বরিশালের মানুষ ভালো জানেন। তাই হাতপাখার বাক্সে ভোট পড়বে কি না সেটা ১২ তারিখই দেখতে পারবেন। ফলে লাঙ্গল ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছি না।
এদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও মিডিয়া সেলের প্রধান লস্কর নুরুল হক বলেন, খোকন সেরনিয়াবাত একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। নগরপিতা হিসেবে অন্য প্রার্থীদের থেকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে। এ কারণে বিএনপির অনেক ভোটার খোকন সেরনিয়াবাতকে ভোট দেবেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, বরিশালের উন্নয়নের জন্য হলেও দল মত নির্বিশেষে সবাই আমাকে ভোট দেবে। কারণ আমি নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় বরিশালকে আরও ঢেলে সাজাবো। নিজ এলাকার উন্নয়ন সবাই চায়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও ব্যক্তি পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন দলটির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কর্মী মো. আবু তাহের বলেন, কেন্দ্র থেকে নির্দেশ রয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না। কিন্তু নিজ ওয়ার্ডের উন্নয়ন বিবেচনা করে স্থানীয় কাউন্সিলর পদে একজন ভালো মানুষকে ভোট দিতে হবে। সেক্ষেত্রে এবার ইভিএমে ভোট দিতে গেলে তিনটি (মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর) পদে ভোট দিতে হবে। তাই ভোট যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য নিজের পছন্দের কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসবো। বাকি দুটি ভোট ইচ্ছা মতো দেবো।
নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কর্মী সুরুজ মোল্লা, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কর্মী আনোয়ার হোসেন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কর্মী আবু বক্কর এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কর্মী মো. সাইফুল ইসলামসহ অসংখ্য বিএনপি কর্মীরা একই কথা বলেন। তবে তারা মেয়র প্রার্থীর ভোট কাকে দেবেন তা নিজেরাও নিশ্চিত নন।
তবে বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির বলেন, এ সরকারে অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী দেওয়া হয়নি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মী হয়ে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাদের ‘মীরজাফর’ আখ্যা দিয়ে দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। সেখানে ভোট চুরির যন্ত্র ইভিএমে ভোট দিতে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী কেন্দ্রে যাবে না।
এফএ/এএইচ/এমএস