সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪
চার বছরের তমা জানে তার বাবা ঘুমাচ্ছে
শ্রম বিক্রির জন্য প্রতিদিন সিলেট নগরের আম্বরখানা বড়বাজারে জড়ো হন শ্রমিকরা। লোকজন এসে তাদের দৈনিক ৬০০-৭০০ টাকা মজুরিতে কাজে নিয়ে যান। কারও মাটি কাটা, কারও নির্মাণাধীন বাড়ির জোগালি বা রাজমিস্ত্রির সহকারী, আবার কারও ভাবনের ছাদের ঢালাইকাজে এসব শ্রমিকদের পিকআপে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনটি এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
প্রতিদিনের মতো আজ বুধবারও ভোরে ৩০ জন শ্রমিককে সিলেটের ওসমানীনগরে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একটি পিকআপে করে। গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়ার পথে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের নাজিরবাজারের কুতুবপুর এলাকায় ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় এক নারীসহ ১৪ নির্মাণশ্রমিকের। তবে পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন অনেকেই।
ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ। আহত-নিহতদের স্বজনদের হাউমাউ করে কান্নার রোল হাসপাতালজুড়ে। নিহতদের মধ্যে আছেন কারও সন্তান, কারও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা, কারও স্বামী আবার কারও ভাই বা স্বজন।
হাসপাতালের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়ার (২৭) ফুপাতো ভাই মো. শাহীন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পাশে থাকা স্বজনরা।
আরও পড়ুন: সিলেটে ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে ১৪ শ্রমিক নিহত
মো. শাহীন জানান, পাঁচ মাস আগে দুলালের বড় ভাই হেলাল মিয়া ছাতকে এক নৌদুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও এক সন্তান রেখে যান। মারা যাওয়ার দুই মাস পর হেলালের আরেক সন্তানের জন্ম হয়। দুই অবুঝ সন্তান নিয়ে অসহায় ভাবির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় দুলাল মিয়ার কাঁধে। এক মাস আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে (২৫) বিয়ে দেন দুলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর অভাবের তাড়নায় কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা সাপ্লাই এলাকার একটি কলোনিতে।
দুলাল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে। আজ সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের নাজিরবাজারে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ নির্মাণশ্রমিকের মধ্যে একজন দুলাল মিয়া (২৫)। স্বামীকে হারিয়ে তার স্ত্রী শারমিন এখন বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। শাহিন মিয়া বলেন, তার এ কষ্টে সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই।
একই দুর্ঘটনায় দুলালের সঙ্গে মারা গেছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মধুপুরের বাসিন্দা নির্মাণশ্রমিক সাধু মিয়া (৪০)। মৃত্যুকালে তিনি দুটি কন্যাসন্তান রেখে গেছেন। বড় মেয়ে তমার বয়স এখন চার বছর। আর ছোট মেয়ে তায়িবার বয়স আড়াই বছর। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সাধুর স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম এ অবুঝ দুই মেয়েকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালে ছুটে এসে দেখেন স্বামী আর বেঁচে নেই।
জ্যোৎস্না বেগমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। হাউমাউ করে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আমি এই মেয়েদের নিয়ে এখন কোথায় যাবো? কাকে তারা বাবা বলে ডাকবে। আমি এখন কী করবো?’
তার পাশে বড় বোন দিলওয়ারা বেগমের কোলে চার বছরের তমা। সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। তমা এখনো বোঝেনি তার বাবা আর কোনোদিন আসবে না। তাকে আদর করে কোলে টেনে নেবে না।
‘তোমার বাবা কোথায়’ বলতেই তমা বলে, ‘বাবা ঘুমাচ্ছে’। দিলওয়ারা বলেন, ‘বোনের জামাইটা (ভগ্নিপতি) খুব ভালো মানুষ ছিলেন। এত কষ্টের মধ্যেও হাসিখুশি থাকতেন।’
দিরাইয়ের ভাটিপাড়া গ্রামের সৌরভ মিয়া (২৫) মারা গেছেন ঘটনাস্থলেই। খবর পেয়ে তার বাবা সিরাজ নুর ও মা আমিনা বেগম হাসপাতালে এসেছেন সন্তানের মরদেহ নিতে। হাসপাতাল চত্বরে ফায়ার সার্ভিসের লাশবাহী ব্যাগের মধ্যে সন্তানের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় তার ভাই জানান, সৌরভ বাড়িতে কৃষিকাজ করতেন। বৈশাখী ধান তোলার পর এখন ভাটিতে আর কাজ নেই। বেকার, তাই ৮-১০ দিন আগে সিলেট এসেছিলেন। ইচ্ছা ছিল দিনমজুরের কাজ করে টাকা জোগাড় করে বিয়ে করবেন।
সৌরভের মা আমিনা বেগম চিৎকার করে কান্নাকাটি করে বারবার বলছিলেন, ‘আমার বিয়ের উপযুক্ত ছেলে মারা গেছে। আমি এ শোক কীভাবে সইবো?পরিবারের একমাত্র রোজগার ছেলে ছিল সে। আমার চার ছেলের মধ্যে সে ছিল সবার চেয়ে শান্ত। কাজকাম নিয়ে থাকতো। এখন আর কে আমারে ‘আম্মা’ বলে ডাকবে?’
এ সড়ক দুর্ঘটনায় দুপুর ২টা পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও ১৬ জন। হতাহতদের সবাই নির্মাণশ্রমিক।
আরও পড়ুন: নিহতদের মধ্যে ১২ জনই সুনামগঞ্জের
নিহতরা হলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার হলদিউড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪৫), নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার দশদার গ্রামের মৃত ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ মিয়া (৪৬), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বাবনগাঁও গ্রামের মৃত ওয়াহাব মিয়ার ছেলে শাহিন মিয়া (৫০), একই উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (২৬), তলেরবন্দ গ্রামের মৃত আমান উল্লাহর ছেলে আউলাদ তালুকদার (৫০), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আলীনগর গ্রামের মৃত শিশু মিয়ার ছেলে হারিস মিয়া (৫০), একই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৬), একই গ্রামের শাহজাহান মিয়ার ছেলে বাদশা মিয়া (১৯), মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া (৫০), মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নুর (৬০), সাগর আহমদ (১৮), উপজেলার মধুপুর গ্রামের মৃত সোনাই মিয়ার ছেলে সাধু মিয়া (৪০), গছিয়া গ্রামের মৃত বারিক উল্লাহর ছেলে সিজিল মিয়া (৩৫) ও কাইমা গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫)।
বিকেল ৩টায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই শুধু সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে মরদেহগুলো পরিবারের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মাসুদ রহমান। তিনি বলেন, এ ঘটনায় পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশ।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সিলেট মহানগর থেকে পিকআপে (সিলেট-ন ১১-১৬৪৭) করে প্রায় ৩০ জন নির্মাণশ্রমিক (নারীসহ) জেলার ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর এলাকায় পৌঁছালে মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী বালুবাহী ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-০৭৮০) সঙ্গে শ্রমিক বহনকারী পিকআপের সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন মারা যান। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পরে মারা যান আরও তিনজন।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হতাহতের দেখতে সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান সিলেট সফররত নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের দাফন-কাফনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করেন।
ছামির মাহমুদ/এসআর/জিকেএস