দেশে ফিরতে চাওয়া ২৩ রোহিঙ্গার খাবার বন্ধ
প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টার ফল হিসেবে স্বেচ্ছায় নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে রোহিঙ্গারা। এরইমধ্যে চার পরিবারের ২৩ নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় ফিরতে প্রত্যাবাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সহযোগিতায় ভাসানচর থেকে উখিয়ার ট্রানজিট পয়েন্টে এসেছেন। কিন্তু মিয়ানমার ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের ওপর রহস্যজনক কারণে চরম বেজার হয়েছে ইউএনএইচসিআর।
দাতা সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসিত হতে আসা রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। রোববার সকালে খাবার বন্ধ করে দেওয়ার পর সিআইসি অফিস থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত খাবার দেওয়া হয়। এরপর একপ্রকার অনাহারে দিন পার করেছেন মিয়ানমারে যেতে নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে আসা চার পরিবারের নারী ও শিশুসহ অন্তত ২৩ রোহিঙ্গা। তবে, মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুর পর্যন্ত একটি বিশেষ সংস্থার সদস্যরা মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের খাবার সরবরাহ করেছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গত ২৪ মে নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে এসে উঠেছেন চার রোহিঙ্গা পরিবারের ২৩ সদস্য। তারা মিয়ানমারে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
ট্রানজিটে আসা রোহিঙ্গারা হলেন আমির হোসেন (৩০), তার স্ত্রী নাসিমা (২৪) এবং তাদের ছেলেমেয়ে রাবেয়া বসরী (১০), উমেন আরা (৭), রাকিবুল হাসান (২)। মোহম্মদ হাসান (৩৬), তার স্ত্রী তৈয়বা (৩৩), ছেলেমেয়ে ইয়ারি জান (১৬), ইয়াসমিন আক্তার (১৩), পারভিন আক্তার (৬), রবিউল আলম (১১), মোহাম্মদ ইউসুফ (৩)। হোসান জোহার (৫৩), তার স্ত্রীর তছমিন আরা (৪০), মেয়ে রসিদা বেগম (১৬), সাহিনা আকতার (৬), ছেলে আকতার ফারুক (১২)। মোহম্মদ হাসান (৩৩), তার স্ত্রীর ফাতেমা খাতুন (২৫), তাদের মেয়ে সারা খাতুন (৬), রমিদা খাতুন (৩), ছেলে মোহাম্মদ ইউনুস (১০) এবং মোহাম্মদ ইউসুফ (৬)।
মিয়ানমারে ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের ইউএনএইচসিআরের খাবার বন্ধ করা প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোববার থেকে হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মিয়ানমারে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের (রেশন) খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এতে করে আমরা চরম বেকায়দায় পড়েছি।
আরআরআরসির মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাক আর না যাক খাবার পাওয়া প্রত্যেকের অধিকার। এসব রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত আমাদের (সিআইসি) অফিস থেকে খাবার দেওয়া হয়েছে। এরপর আর ব্যবস্থা করতে পারিনি।
মিয়ানমারে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের খাবার দেওয়া বন্ধের বিষয়টি ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হলেও এর বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি বলে উল্লেখ করেছেন মিজানুর রহমান।
এ বিষয়ে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ইউএনএইচসিআরের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, মিয়ানমারে ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের মাঝে ইউএনএইচসিআরের খাবার দেওয়া বন্ধের খবর প্রত্যাবাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের রাজি করানোর দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের মাঝে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এরইমধ্যে রোহিঙ্গারা খাবার বন্ধ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সম্মানজনক প্রত্যাবাসন কামনা করা রোহিঙ্গাদের অনেকে বলছেন, ইউএনএইচসিআর কি তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হোক এটা চায় না? তা না হলে তারা মিয়ানমারে যেতে চাওয়া লোকজনকে খাবার দেওয়া কেন বন্ধ করলো?
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমারে যাওয়ার আগে যদি এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাহলে সামনে প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের রাজি করাতে কষ্ট হবে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
মিয়ানমার ফিরতে পরিবার নিয়ে ট্রানজিট পয়েন্টে আসা আমির হোসেন বলেন, আশ্রিত জীবন আর হজম করতে পারছি না। তাই নিজ দেশে জীবন যা-ই হোক মেনে নিয়ে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার বাসনা করেছি। এতদিন আশ্রিত জীবনে জাতিসংঘ মনভরে খাবার দিয়েছে। কিন্তু কেন জানি না, যাবার বেলায় উপোস রাখছে। আমরা বউ-বাচ্চা নিয়ে খাবার সংকটে গত দুইটা দিন পার করলাম।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের রাখাইনে ফেরত নিতে প্রত্যাবাসন চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চুক্তি সই করলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি। এ কমিটি একাধিক সভা করলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। তবে খুব দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর ট্রানজিট পয়েন্টে অবস্থান করা চার পরিবারের ২৩ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হলে এটিই হবে প্রত্যাবাসনের স্বপ্নযাত্রা।
সায়ীদ আলমগীর/এমআরআর