ফের ধূলিকণায় ঢাকছে ‘নির্মল বাতাসের শহর’
রাজশাহীর বাতাস নির্মল শুনে কয়েক বছর ধরে রাজশাহী আসার কথা ভাবছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সিমা মন্ডল। এবার ছুটি মিলেছে তার। রাজশাহী রেলগেট এলাকায় নামেন তিনি। ভেবেছিলেন গাড়ি থেকে নেমে বিশুদ্ধ শ্বাস নেবেন প্রাণভরে। তবে শুরুতেই আশাহত হন সিমা। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের কাজ চলমান থাকায় ধুলা উড়িয়ে চলছে সব যানবাহন। পাশের দোকান থেকে একটি মাস্ক কিনে শুরু করলেন যাত্রা।
শনিবার (৩ জুন) সিমা জাগো নিউজকে বলেন, রাজশাহীতে নেমে যে নির্মল বাতাস পাবো ভেবেছিলাম সেটি পাইনি। বরং শুরুতে রাজশাহী আমাকে অভ্যর্থনা জানালো ধুলায়। বাতাস এখানে খুব খারাপ। ধুলার কারণে মাস্কই খুলতে পারছি না।
সিমার মতো অনেকেরই ধারণা ছিল রাজশাহী এখনো সেই নির্মল বাতাসের শহর। গত কয়েকবছর আগেও বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল রাজশাহী। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালে এ সফলতা আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্তের ভিত্তিতে রাজশাহী এটি অর্জন করে।
সেসময় প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে রাজশাহীর বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা (১০ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম। এটা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রামে। দুই বছর আগে এ শহরে আরও ক্ষুদ্র ধূলিকণা (২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ৭০ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৬ সালে এটি প্রায় অর্ধেক হয়ে দাঁড়ায়, ৩৭ মাইক্রোগ্রাম।
সম্প্রতি রাজশাহীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, রাজশাহীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ ফের বেড়েছে। বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে বারিন্দ এনভায়রনমেন্টের সহযোগিতায় রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানের বাতাসে বিদ্যমান বস্তুকণা ২০২২ সালের ৫ মার্চ পরিমাপ করা হয়। এতে দেখা যায়, পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২ দশমিক ৫ এবং পার্টিকুলেট ম্যাটার ১০ পাওয়া যায় তালাইমারী মোড়ে যথাক্রমে ৭৬ এবং ৮৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, যা ২০১৪ সালের থেকে যথাক্রমে ১২ দশমিক ১ ও ৪৮ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার বেশি। এসময় রেলগেট এলাকায় পাওয়া যায় ৭৩ ও ৮৪ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, বিসিক মঠ পুকুর এলাকায় ৫৬ ও ৬৮ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, লক্ষ্মীপুর এলাকায় ৭১ ও ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার এবং সাহেব বাজার এলাকায় ৫৫ ও ৬৬ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। প্রাপ্ত সর্বোচ্চ পিএম ২ দশমিক ৫ বাংলাদেশের নির্ধারিত ঘনমাত্রার চেয়ে সামান্য বেশি হলেও প্রাপ্ত সর্বোচ্চ পিএম ১০ এর পরিমাণ নির্ধারিত ঘনমাত্রার চেয়ে অনেক কম। পর্যবেক্ষণে বিসিক মঠ পুকুরের কাছে বায়ুর মান তুলনামূলক বেশ ভালো পাওয়া যায়।
এরপর ২০২২ সালের ২০ আগস্ট শুষ্ক মৌসুমে একযোগে ওই পাঁচটি স্থানে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছিল। এতে বায়ুতে সর্বোচ্চ পিএম ২ দশমিক ৫ এবং পিএম ১০ পাওয়া যায় তালাইমারী মোড়ে যথাক্রমে ৪১ ও ৪৯ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। রেলগেট এলাকায় ৩৮ ও ৪৬ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, বিসিক মঠ পুকুর এলাকায় ৩৭ ও ৪৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, লক্ষ্মীপুর এলাকায় ৩৭ ও ৪৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার ও সাহেব বাজার এলাকায় ৩৫ এবং ৪২ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। তবে পরীক্ষা চলাকালীন আকাশ মেঘলা ছিল এবং মৃদু বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে বাতাসের ধূলিকণা কিছুটা কম এসেছে।
বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সভাপতি প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যেসব স্থানে গবেষণা করেছি সেসব স্থানেই বাতাসের ক্ষুদ্র বায়ুকণা বেশি পেয়েছি। বিশেষ করে ২ দশমিক ৫ ধরনে বায়ুকণা বেশি পেয়েছি। পিএম ২ দশমিক ৫ কে বলা হয় ফাইন পার্টিকলেস। এটা ফুসফুসের গভীরে যেতে পারে, এমনকি রক্তের প্রবাহেও যেতে পারে। এর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ফুসফুস ও হার্টের ক্ষতি করে। পিএম ১০ কে বলা হয় কোর্স পার্টিকলেস। এটা তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। এটার জন্য চোখ, নাক ও গলায় অস্বস্তিবোধ হয়।
তিনি বলেন, রাজশাহীর বাতাস এখন যদি পরীক্ষা করা হয় তবে এটি বাড়বে, কমবে না। এখন রাজশাহীর মানুষ জানে রাজশাহীতে একটি টেবিল যদি রেখে দেওয়া হয় পরদিন ধুলায় নাম লেখা যাবে। মূলত অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্যই বাতাসের এই ধূলিকণা বেড়েছে।
জাকির হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের নির্মাণ নির্দেশনায় বলা আছে, রাস্তা নির্মাণের সময় যে খোয়া, বালি নিয়ে যাওয়া হবে সেটি ঢেকে পরিবহন করতে হবে। এছাড়াও এটি যদি কোথাও স্তূপ আকারে রাখা হয় তবে সেখানেও ঢেকে রাখতে হবে। রাস্তার কাজ চলার সময় সেখানে নিয়মিত পানি দিতে হবে। রাজশাহীতে এই সময়ে অনেক রাস্তার কাজ চলছে। কিন্তু আমার মনে হয় না সেখানে ৭-১০ দিনে কোনো পানি দিয়েছে কিংবা তারা ঢেকে রেখেছেন। ফলে অপরিকল্পিত নির্মাণ ও গাছ কম থাকার কারণেই বাতাসের এই দূষণ বাড়ছে। শুধু নির্মাণখাতই যদি তাদের নির্দেশনা মেনে চলে তবে এই দূষণ অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ কমে আসবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন বলেন, ১০ মাইক্রোমিটার অথবা তার চেয়ে কম ব্যাসের কণা কোনো নির্দিষ্ট উৎস অথবা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীতে তো কোনো ডিজেলচালিত যানবাহন নেই। শিল্প-কারখানাও তেমন নেই। শুধু রাস্তা-ঘাট নির্মাণের কারণেই এটি বাড়ছে। এটি কমাতে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বাতাসের যে দূষণ সেটি আমাদের সবাইকেই বুঝতে হবে। এই শহরকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচাতে চাইলে বড় বড় গাছ লাগাতে হবে। এই শহরে এখন অনেক কাজ চলছে, সেগুলো নিয়ম মেনেই করতে হবে। নির্ধারিত সময়ই শেষ করতে হবে। তবেই এই দূষণ কিছুটা কমে আসবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম বলেন, আমাদের সব কাজ নিয়ম মেনেই করা হয়। আমাদের ঠিকাদারদের নজরদারিতে রাখি। নিয়মিত পানিও দিতে বলা হয়।
সাখাওয়াত হোসেন/এএসএ/এমএস