যত্রতত্র বর্জ্য

১০ বছরেও ডাম্পিং স্টেশন করতে পারেনি গাজীপুর সিটি করপোরেশন

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম আমিনুল ইসলাম , জেলা প্রতিনিধি গাজীপুর
প্রকাশিত: ০৭:৩৪ পিএম, ০৫ জুন ২০২৩
গাজীপুরে সড়কের পাশে এভাবে ফেলে রাখা হয় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, এতে দূষণ হচ্ছে পরিবেশ

ধরুন আপনি রাজধানী ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও সিলেট থেকে সড়কপথে গাজীপুর গেলেন। কিন্তু আপনি যে গাজীপুর প্রবেশ করেছেন তা বুঝবেন কীভাবে? এ অঞ্চলের বাসিন্দারা বলেন, ময়লা-আবর্জনা দেখেই বুঝবেন গাজীপুরে প্রবেশ করেছেন। কারণ গাজীপুরে প্রবেশ করলেই সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়বে ময়লার স্তূপ। ময়লার স্তূপ নেই, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে না- এমন এলাকা খুঁজে পাওয়া কঠিন এখানে।

এ অবস্থার জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে দায়ী করছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, ১০ বছর পার হতে চলেছে সিটি করপোরেশন হয়েছে। কিন্তু এখনো গড়ে ওঠেনি ময়লা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন। এই ১০ বছর ধরে শুধু আশ্বাসের বাণীই শুনিয়ে গেছে সিটি করপোরেশন।

দেখা যায়, নগরীর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে কড্ডা এলাকায় বর্জ্য ফেলার স্থানটি এখন ময়লার পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রীদের নাকে-মুখে রুমাল চেপে যেতে হয়। আর এখানের বাসিন্দাদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ময়লার গন্ধে এলাকাবাসী অতিষ্ট বছরের পর বছর।

jagonews24

সড়কের পাশে এভাবেই ময়লার পাহাড় বানিয়ে রেখেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন

আরও পড়ুন: গাজীপুর সিটিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রকল্প আছে বাস্তবায়ন নেই

সরেজমিনে দেখা যায়, কড্ডা এলাকায় প্রতিদিন তিন-চারটি ভেকু (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে নিচ থেকে ওপরে তোলা হচ্ছে ময়লা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারি সারি ময়লার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে এখানে।

অপরদিকে নগরীর টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সড়কের মুখে নিমতলী ব্রিজের পাশে এবং টঙ্গী বাজার, বড়বাড়ি, কুনিয়া তারগাছ ও কড্ডা এলাকার মূল সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা হয় ময়লা। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডের অলিগলি সয়লাব ময়লা-আবর্জনায়। সিটি করপোরেশনই এসব খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখে ময়লা-আবর্জনা।

আরও পড়ুন: সিটি করপোরেশনে থেকেও লাগেনি শহুরে ছোঁয়া

কড্ডা এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, দেশের আর কোথাও এমন নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন নগর নেই। সিটিতে নির্বাচিত দুজন মেয়র এবং দুই দফায় দায়িত্ব পাওয়া বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেয়র ময়লার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ডাম্পিং স্টেশন করতে পারেননি। এছাড়া ১০ বছরে একজন মেয়র পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে না পারায়, আলোর মুখ দেখতে পারেনি তাদের প্রকল্পগুলো।

jagonews24

কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ময়লার গন্ধে এলাকাবাসী অতিষ্ট বছরের পর বছর

২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন। ওই বছরই এ সিটি করপোরেশনে প্রথম মেয়র নির্বাচন হয়। এতে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এম. এ. মান্নান। এরপর আওয়ামী লীগের হয়ে গাজীপুর সিটির মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। পরে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। সবশেষ ২০২৩ সালে গাজীপুরের মেয়র হন জাহাঙ্গীরে মা জায়েদা খাতুন।

পরিবেশবিদ ও নদী গবেষক মনির হোসেন বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিজেই নদী তথা পরিবেশ দূষণ করছে। খোলা জায়গায় সিটি করপোরেশনের ফেলা এসব ময়লার শেষ ঠিকানা নদী ও জলাধার। অর্থাৎ আমরা শুনেছি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অনেকগুলো প্রকল্প হবে। কিন্তু ১০ বছরে কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। শুধু তারা জায়গাই খুঁজছে।

আরও পড়ুন: ‘স্বশিক্ষিত’ জায়েদা দেশের দ্বিতীয় নারী সিটি মেয়র

গাজীপুরের তরল বর্জ্য তুরাগ নদ, চিলাই নদী, মোগরখাল, হায়দারাবাদ খালসহ আশপাশের সব জলাশয় দূষিত করছে বলে জানান এই পরিবেশবিদ। তিনি বলেন, নদী ও খালগুলো দূষণমুক্ত রাখার কোনো পদক্ষেপ নেই সিটি করপোরেশনের। শুধু তরল বর্জ্য নয়, কঠিন বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদী ও খালে। কঠিন বর্জ্যগুলো নদীর তলদেশে চলে যায় বা ভেসে থাকে। আর তরল বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে পানি। মরে যাচ্ছে মাছসহ জলজ প্রাণী।

jagonews24

কড্ডা এলাকায় বর্জ্য ফেলার স্থানটি এখন ময়লার পাহাড়ে পরিণত হয়েছে

নগরীর ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে ভ্যানে করে ময়লা-আবর্জনা আনার জন্য ঘরপ্রতি ৫০ টাকা করে দিতে হয়। আর সিটি করপোরেশন এসব ময়লা নিয়ে কড্ডা এলাকায় ফেলে দেয়। অনেক সময় তো দুই-তিনদিনেও বাসাবাড়ি থেকে ময়লা নেওয়া হয় না।

আরও পড়ুন: ‘পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট’

গাজীপুর শহরের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাসাবাড়ি, দোকানপাট কিংবা শিল্পকারখানার ময়লা ফেলার জন্য মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে অন্তত ৭০টি ডাম্পিং স্টেশন করা প্রয়োজন। অথচ একটিও নেই। আমরা নূন্যতম নাগরিক সুবিধা পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ড্রেনের সঙ্গে বিভিন্ন বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্যের লাইন সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেই বর্জ্য গিয়ে পড়ছে গাজীপুর শহরের পাশের চিলাই নদীতে। টঙ্গী এলাকার তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগের জলে। প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে নদনদী, খালবিল।

এসব অভিযোগের বিষয়ে খোদ সিটি করপোরেশনও দ্বিমত পোষণ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো নগরের ময়লা-আবর্জনা সরানোর জন্য অন্তত পাঁচ হাজার লোক প্রয়োজন। সেখানে লোকবল আছে মাত্র ৩৮০ জন।

আরও পড়ুন: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা

এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য নিয়ে কাজ করার যে দক্ষতা, লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার সেটা আমাদের এখনো হয়নি। পাশাপাশি আমাদের ডাম্পিং স্টেশনও নেই। তবে এরই মধ্যে দুটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ময়লা ফেলার সাব-স্টেশনের জন্য পাঁচ কাঠা করে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। করপোরেশনের বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। নির্দিষ্ট জায়গা কেনার চেষ্টা চলছে।

jagonews24

তিনি বলেন, স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন গড়ে তোলার জন্য মহানগরের ইটাহাটা, মজলিশপুর ও কাউলতিয়া এলাকায় ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া সিটি করপোরেশনের এসব বর্জ্য দিয়ে জৈব সার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। ডাম্পিং স্টেশনের জন্য ১০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণের কাজও চলমান, যেখানে বর্জ্য থেকে উৎপাদন করা হবে বিদ্যুৎ।

এছাড়া নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে নগরীর মেঘডুবি এলাকায় পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজ চলছে বলে জানান গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

তিনি বলেন, এ সিটিতে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে সম্ভব হয় আড়াই হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা। বাকি বর্জ্যগুলো বিভিন্ন সড়কের পাশে কিংবা আনাচে-কানাচে পড়ে থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, দূষিত হয় পরিবেশ।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ বলেন, ডাম্পিং স্টেশনের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষের দিকে। শিগগির নতুন জায়গায় ডাম্পিং করা সম্ভব হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিটি করপোরেশনের বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে।

জেডএইচ/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।