নার্সারির কারণে বদলে গেছে যে গ্রামের নাম

মিলন রহমান মিলন রহমান , জেলা প্রতিনিধি, যশোর
প্রকাশিত: ১০:৪৬ এএম, ০৫ জুন ২০২৩
গাছের চারার পরিচর্যায় ব্যস্ত ‘নার্সারি গুরু’ মোহাম্মদ আলী

অডিও শুনুন

৫৫ বছর ধরে নার্সারির সঙ্গে যুক্ত যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী (৭২)। জানালেন তার হাত দিয়ে ২০ লক্ষাধিক গাছের চারা উৎপাদন করে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারাদেশে। দেশে লাগানো যায় এমন কোনো গাছের চারা নেই যা তিনি উৎপাদন করেননি। তার দেখাদেখি বাসুদেবপুর ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য নার্সারি। আর বাসুদেবপুর তো পরিণত হয়েছে ‘নার্সারি গ্রামে’। এখন এ নামেই সবাই চেনে গ্রামটিকে।

যশোর শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বাসুদেবপুর গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে চারশ বাড়িতেই আছে নার্সারি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক নার্সারি শতাধিক। আর বাসুদেবপুর বাজারের শতাধিক ছোট-বড় চারা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন গ্রামের চারভাগের তিনভাগ বাসিন্দাই নার্সারির সঙ্গে জড়িত।

jagonews24

গ্রামের যেদিকেই চোখ যায় শুধুই নার্সারি আর গাছের চারা। এমন কোনো চারা নেই যা পাওয়া যায় না। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা থেকে শুরু করে দেশি সবধরনের ফল ছাড়িয়ে আপেল, কমলালেবু, আঙুর, মাল্টা, বিদেশি পার্সিমন, ডরিয়ান, রামবুটান, পিনাক বাটার, কিউই, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দনসহ বিভিন্ন ফলদ ও ভেষজ গাছের চারা রয়েছে এই নার্সারিগুলোতে।

স্থানীয়রা জানান, বছরজুড়ে সারাদেশে ট্রাক ভর্তি করে চারা সরবরাহ করেন নার্সারি মালিকরা। নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর থেকে বছরে প্রায় এক কোটি গাছের চারা ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। এতে একদিকে যেমন গ্রামজুড়ে সবাই স্বাবলম্বী হয়েছেন; তেমনি এই বিপুল পরিমাণ চারা উৎপাদন করে তারা ভূমিকা রাখছেন পরিবেশ রক্ষায়।

বাসুদেবপুরে নার্সারির গোড়াপত্তন করেন মোহাম্মদ আলী। মণিরামপুর উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় তিনি ‘নার্সারি গুরু’ হিসেবেই পরিচিত। বাজারের পাশে ‘পুরাতন নার্সারি’ নামে তার প্রতিষ্ঠানটি এখন ছেলেরা দেখাশোনা করেন।

jagonews24

শুরুর কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী ফিরে যান প্রায় ৬০ বছর আগের অতীতে। তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। বাবা ওলিউল্লাহ মুন্সীর সঙ্গে ঝিকরগাছা বাজারে যেতেন লিচুর কলমের চারা নিয়ে। এক, দু আনা দরে বিক্রি করতেন। সে সময় নৌকায় করে বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা ঝিকরগাছায় আসতেন আমড়া, তেজপাতা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছের চারা নিয়ে। তাদের চারা পর্যবেক্ষণ এবং আলাপ আলোচনা করে ধীরে ধীরে শেখার চেষ্টা করেন অন্য গাছের চারা তৈরির পদ্ধতি। লিচুর পরে সুপারির চারা করতেন মোহাম্মদ আলী। পরে জামরুল, তেজপাতা, সফেদা, আম, কুল, পেয়ারা ইত্যাদির চারা ও কলম তৈরি শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৫৫ বছর ধরে তিনি নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারাদেশে। কোনো কোনো বছর এক, দুই লাখ চারাও উৎপাদন করেছেন।

মোহাম্মদ আলী আরও জানান, তার বাবা নার্সারির ব্যবসা শুরু করলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন তিনি। এখন এই গ্রামে খুব ভালোমানের চারা তৈরি হয়। অন্য এলাকার তুলনায় দামেও কম। যে কারণে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ সারাদেশের পাইকারি বিক্রেতা ও কৃষি উদ্যোক্তারা এখান থেকে চারা কিনে নিয়ে যান। মোহাম্মদ আলী চারা তৈরি ও ব্যবসা করে ২৫ বিঘা জমি কিনেছেন। পাকা বসতবাড়ি বানিয়েছেন।

এখন ‘পুরাতন নার্সারি’র একাংশ দেখাশোনা করেন মোহাম্মদ আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাবার হাত ধরেই তিনি নার্সারি ব্যবসায় এসেছেন। তাদের নার্সারি থেকেই বছরে কয়েক লাখ গাছের চারা সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি গ্রামের ঘরে ঘরে এখন নার্সারি। সারাবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা গাছের চারা সরবরাহ করেন। গ্রামের চার শতাধিক নার্সারি থেকে সারাবছর যে চারা সরবরাহ করা হয় তার সংখ্যা কোটি স্পর্শ করবে।

তিনি আরও উল্লেখ, এবছর উত্তরবঙ্গ থেকে যে পরিমাণ লিচুর চারার অর্ডার রয়েছে তার দামই দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। আসন্ন মৌসুমে এই চারা সরবরাহ করা হবে।

jagonews24

আকাশ নার্সারির স্বত্বাধিকারী শাহজাহান কবীর জানান, বাবার হাত ধরে ১৮ বছর আগে তিনি নার্সারির কাজে যুক্ত হন। তার নার্সারিতে এখন ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। নার্সারিতে তিনি আম, আমড়া, পেয়ারা, কমলালেবু, মাল্টা, মিষ্টি তেঁতুল, জলপাইসহ ফলদ, বনজ ও ঔষধি বিভিন্ন গাছের চারা উৎপাদন করেন। বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা গাড়ি ভরে এসব চারা কিনে নিয়ে যান। বছরে তিনি প্রায় ৫০ হাজার চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকেন।

নার্সারি শ্রমিকের কাজ করা ভোলানাথ সরকার বলেন, গ্রামের ঘরে ঘরে নার্সারি হওয়ার পর এখন আর কাজের অভাব হয় না। গ্রামের শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ নার্সারিতে কাজ করেন এবং যে বেতন পান তাতে সংসার চলে যায়।

গ্রামে নার্সারির প্রসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাল হোসেন বাড়ির উঠান ও ছাদে নার্সারি করেছেন তিনবছর হলো। তিনি জানালেন, বাড়ির ছাদে ও উঠানে তার ৬০ রকমের গাছের চারা রয়েছে। গত বছর তিনি চারা বিক্রি করে তিন লাখের বেশি টাকা আয় করেছেন।

এ বিষয়ে মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরেই নার্সারি। তারা অনেক ধরনের গাছের চারা উৎপাদন এবং বছরজুড়ে সারাদেশে সরবরাহ করে থাকেন। বিশেষ করে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন জাতের চারা তৈরি করে সরবরাহ করেন। এই নার্সারির মাধ্যমে গোটা গ্রামের মানুষ যেমন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন; তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে; তেমনি লাখ লাখ গাছের চারা উৎপাদন করে তারা পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

এমআরআর/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।