কারখানার নেই পরিবেশ ছাড়পত্র, ধোঁয়া-দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ গ্রামবাসী
পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর আবাসিক এলাকায় একটি কারখানার চুল্লিতে পাটখড়ি পুড়িয়ে কার্বন ও ছাই তৈরি করা হচ্ছে। বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত চলে পোড়ানোর কাজ। ধোঁয়া আর দুর্গন্ধ ছড়ায় চারদিক। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওই এলাকার জীবনযাত্রা। আছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
এলাকাবাসী জানান, পৌর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার পদ্মাকর ইউনিয়নের অচিন্তানগর গড়ে ওঠে তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামে একটি কারখানা। স্থাপনের সময় গ্রামবাসীকে বলেছিল কারখানায় পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন তৈরি করা হবে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, কোনো ধোঁয়া হবে না। তিন বছর পর কারখানা অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু আজও তা করা হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কারখানায় বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত পাটখড়ি পোড়ানোর ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে গ্রামটি। যার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। বাড়িঘরে পড়ছে কয়লা, কালো ধোঁয়ার আস্তরণ। এমনকি কমেছে আশপাশের ফসলি জমির উৎপাদনও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কারখানাটিতে নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, বাস্তবায়ন করা হয়নি ফায়ার সেফটি প্ল্যান। তবুও বছরের পর বছরর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাটখড়ি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কার্বন ও ছাই। পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৪ সালের পর তিনবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডও ঘটেছে। সেখানে দগ্ধ হন ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মী ও চীনা নাগরিকসহ ছয়জন। দীর্ঘদিন এমন অব্যবস্থাপনা চললেও দেখা যায়নি কোনো পদক্ষেপ। এমনকি কারখানা কর্তৃপক্ষের ভয়ে কিছু বলতেও সাহস পান না স্থানীয়রা।
আরিফুল ইসলাম নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী বলেন, প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করি। বিকেল বা সন্ধ্যায় এ রাস্তা দিয়ে গেলে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে সমস্ত রাস্তা। এছাড়া ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আতিয়ার রহমান বলেন, যখন পাটখড়ি পোড়ায় তখন প্রচুর ধোঁয়া বের হয়। নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। বিকট গন্ধ হয় এলাকায়। বেশি সমস্যা হয় কারখানার আশপাশের বসবাসকারী মানুষের। বাড়িতে ধুলায় টেকা যায় না।
স্থানীয় অনেক গৃহবধূ জানান, তারা এক প্রকার জিম্মি কারখানার কাছে। ধোঁয়া আর দুর্গন্ধে টেকা যায় না। হয়তো কোনো কেমিক্যাল মেশানো হয়। না হলে এতো গন্ধ হওয়ার কথা না। এতো অত্যাচার তবুও ভয়ে কিছু বলতেও সাহস পান না তারা। কিছু বললেই কারখানার লোকজন স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ে বাড়িতে এসে ভয়ভীতি দেখায়।
পদ্মাকর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিকাশ কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে যখন পাটখড়ি পোড়ে তখন ধোঁয়া যেদিকে যায় সেখানকার মানুষ টিকতে পারে না। দুর্গন্ধ আর ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়। এলাকার মানুষ অনেক কষ্টে আছে। কাউকে এ বিষয়ে বলেও কোনো কাজ হয় না।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যধি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম আশরাফুজ্জামান সজীব জাগো নিউজকে বলেন, পাটখড়ি আংশিক পোড়ালে কার্বন মনোক্সাইড এবং ধূলিকণা বের হয়। শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে হাঁপানি রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ধূলি জমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতাও কমতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ক্রনিক ব্রংকাইটিস ও ইন্টার স্টিশিয়াল লাং ডিজিজি এ আক্রান্তের শঙ্কাও থেকে যায়। অনেক সময় অক্সিজেন বন্ধ হলে হাইড্রো কার্বন জাতীয় বাতাস বের হয় যা ফুসফুস ক্যানসারের জন্য দায়ী।
বিষয়টি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঝিনাইদহের দায়িত্বে থাকা ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কারখানাটি ফায়ার লাইসেন্স থাকলেও ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে বলা হলেও আগ্রহ দেখায়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফায়ার সার্ভিসের যতটুকু করণীয় সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ঝিনাইদহ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্রীরুপ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, কারখানাটির কোনো ছাড়পত্র নেই। আমি সেখানে কয়েকবার গিয়েছি। কয়েক দিন আগেও গিয়েছিলাম সঠিকভাবে কারখানা চালাতে বলে এসেছিলাম।
কারখানার ম্যানেজার কামরুল হাসান বলেন, জেলা কার্যালয় থেকে ছাড়পত্র না পেলেও তাদের অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়েছে কারখানাটি চালানোর জন্য। তবে তিনি এ অনাপত্তিপত্রটি দেখাতে রাজি হননি তিনি।
তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কারখানাটির সহকারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে যাবো। এখানে অগ্নি নির্বাপণের সব ব্যবস্থা আছে। ফায়ারের অফিসার বলেছে আমাদের প্রশিক্ষণ নেই। সে কি বোঝে প্রশিক্ষণ কী। এখানে পাটকাঠি কিনে পোড়ানো হয়। গ্রামের মানুষ কাজ করে। এছাড়া এ এলাকার কৃষি পণ্যের সহজ বিক্রি করতে পারে কৃষক।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ইকবাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ আবেদন করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের শর্তাবলী পূরণ না হওয়ায় কোনো ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। তারা ঝিনাইদহ কার্যালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার যে কথা বলছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ছাড়পত্র ছাড়া অনাপত্তি পত্র দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে।
এসজে/এএসএম