দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

আবু হোসাইন সুমন আবু হোসাইন সুমন মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশিত: ০৮:১৭ এএম, ০৯ মে ২০২৩
মৌসুমের শুরুতে প্রথম দফায় ঘেরে ছাড়া পোনার বেশিরভাগই মারা গেছে দাবদাহে

দীর্ঘদিন ধরে চলমান প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টিতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার উপকূলের চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষিরা। মৌসুমের শুরুতে প্রথম দফায় ঘেরে ছাড়া পোনার বেশিরভাগই মারা গেছে দাবদাহে। দ্বিতীয় দফায় পোনা ছাড়া হলে সেগুলোও মারা যাচ্ছে। অথচ এখানে উৎপাদিত চিংড়ি ও কাঁকড়ার সিংহভাগই রপ্তানি হয় বিদেশে।

উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মোংলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার চিংড়ির ঘের রয়েছে। তার মধ্যে পশুর নদীর ড্রেজিংয়ের বালু ফেলায় শুধু চিলা ইউনিয়নেই প্রায় ৩০০ ঘের ভরাট হয়ে ঘেরের সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়া শিল্পায়নের কারণে বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘেরের সংখ্যা কমেছে দেড়শর মতো। নানা কারণে উপজেলায় ঘেরের সংখ্যা কমে আসছে। অথচ এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও আয়ের একমাত্র উৎস হলো এ ঘের। ঘের কমে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার।

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে উপকূলবাসী

উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, উপজেলায় নিবন্ধিত বাগদা চিংড়ির ঘেরের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৮৬টি। গলদা চিংড়ির ঘের ২ হাজর ৯৬০টি। তবে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিতসহ মোট ঘেরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। সাড়ে ১২ হাজার ঘেরের মধ্যে প্রায় ৫০০ ঘের কমে গেছে ভরাট ও শিল্পায়নে। প্রতিবছর এখানকার বাগদা চিংড়ির ঘেরে ১০ কোটি আর গলদা চিংড়ির ঘেরে ৩ কোটি পোনা ছাড়েন ঘের মালিকরা। তবে সে তুলনায় চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে খুবই কম। এর মধ্যে দাবদাহে মরে যাচ্ছে পোনা।

মিঠাখালী ইউনিয়নের চিংড়ি ঘের মালিক মাহমুদ হাসান ছোট মনি ও সুমেল সারাফাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের আটি ঘেরে প্রথম দফায় যে পোনা ছেড়েছিলাম তার ৯৫ শতাংশই মারা গেছে। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় যে পোনা ছেড়েছি তাও প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও পানিতে অতিমাত্রার লবণাক্ততায় পোনা মারা যাচ্ছে।’

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

আরও পড়ুন: সময়ের আগেই পাকছে লিচু, কমছে স্বাদ

চিলা ইউনিয়নের ঘের মালিক আবু হোসেন পনি বলেন, ‘মৌসুমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আট দফায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার পোনা ছেড়েছি। কিন্তু মাছ পেয়েছি মাত্র ৮ হাজার টাকার। বাকি মাছ মরে গেছে গরম ও লবণে (লবণাক্ততায়)।’

চাঁদপাই ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী মোল্লা তারিকুল ইসলাম, সুন্দরবন ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী ইব্রাহিম হোসেন ও বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘের ব্যবসায়ী কাকন শেখ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ঘের করে দিন দিন লোকসানে রয়েছি।

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

আরও পড়ুন: হবিগঞ্জে ৩৭ দিনে ১৭ খুন

চিলা ও চাঁদপাই ইউনিয়নের কাঁকড়া চাষি রিমু বিশ্বাস ও তপন গোলদার বলেন, ‘আমাদের কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। তবে যে পরিমাণ গরম পড়ছে তাতে কাঁকড়ার ক্ষতি হচ্ছে। দাবদাহে ঘেরের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিও হচ্ছে না। কাঁকড়া রাখার জায়গা বারবার পাল্টাতে হচ্ছে।’

করোনাকালে নানা সমস্যার কারণে ঘেরের উৎপাদন কমে গিয়েছিল ৪০-৪৫ শতাংশ। এরপর ধীরে ধীরে ঘেরের উৎপাদন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। কিন্তু চলতি মৌসুমের মার্চ-এপ্রিলে প্রচণ্ড দাবদাহ ও লবণাক্ততার কারণে বেশিরভাগ ঘেরের মাছ মরে যায়। দফায় দফায় পোনা ছাড়লেও আশানুরূপ মাছ পাচ্ছেন না চাষিরা।

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচণ্ড দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, ঘেরের গভীরতা কম থাকা, পানিতে অতিমাত্রার লবণাক্ততা, দুর্বল পোনা ও পর্যাপ্ত খাবার দেওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব কারণেই প্রতিনিয়ত ঘেরের মাছ মরছে।

আরও পড়ুন: হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেবায় রাঁধুনি-মালি-পরিচ্ছন্নতাকর্মী!

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, গত মৌসুমে উপজেলায় ২ হাজর ২৯২ হেক্টর জমির ঘেরে ১ হাজার ৮৩৪ মেট্রিক টন বাগদা, ৯৭০ হেক্টর জমিতে ১ হাজর ৪৫৫ মেট্রিক টন গলদা ও ৩৬০ হেক্টর জমিতে ১৮০ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছিল। ৩১৫ হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ১০১টি ঘের ও পুকুরে উৎপাদন হয়েছিল ৭৮৭ মেট্রিক টন সাদা মাছ। এখানে উৎপাদিত বাগদার ৭০ শতাংশ, গলদার ৫০ শতাংশ ও কাঁকড়ার ৭০ শতাংশ রপ্তানি হয় বিদেশে।

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে ডিসেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত বাগদা ও অক্টোবর পর্যন্ত গলদার চাষ হয়। কেউ ডিসেম্বরে, কেউ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ঘেরে পোনা ছাড়েন। তবে এখানকার ঘেরগুলোতে প্রথম দফায় ছাড়া মাছ মার্চ-এপ্রিলে বিশেষ করে রমজান মাসেই বেশি মারা গেছে। কারণ রমজানজুড়ে প্রচণ্ড দাবদাহ ছিল এখানে।

দাবদাহে মরছে সাদা সোনা

তিনি বলেন, ঘেরগুলোতে গভীরতা কমপক্ষে তিন ফুট থাকা প্রয়োজন। সেখানে বেশিরভাগ ঘেরে রয়েছে এক থেকে দেড় ফুট গভীরতা। এতে প্রচণ্ড দাবদাহ ও গরমে পানি উত্তপ্ত এবং বাষ্পীভূত হচ্ছে। তাতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে। তাই চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি, প্রতিদিন একবার হলেও মানসম্মত খাবার ও চুন ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

এসআর/এএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।