সবজি বেচেই টিকে আছেন রাহিলা-নুরজাহান-সেলিনারা
সত্তরোর্ধ্ব নুর জাহান বেগম। তার বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুবছর পর স্বামী জালালকে নিয়ে চলে আসেন খুলনার ডুমুরিয়ায়। কিন্তু সেখানে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি। বাধ্য হয়ে আবার ফিরে যান কেশবপুরে। সেখানেই তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে ও এক মেয়ে।
৩৮ বছর আগে এ সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান তার স্বামী আব্দুল জালাল। তখন আয়ের একমাত্র উৎস ছিল ছেলে জয়নাল। ২০ বছর আগে ভারী বস্তা তুলতে গিয়ে পড়ে ভেঙে যায় ছেলের মেরুদণ্ড। কিছু দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর শুরু হয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম।
ছেলে মারা যাওয়ার পর আবারও চলে আসেন খুলনায়। নগরীর নিরালা পাইকারী কাঁচাবাজার এলাকায় টোকাইয়ের মতো বিভিন্ন সবজি কুড়িয়ে বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় সেই বাজারও হারাতে হয়। নিরালা বাজার চলে যায় সোনাডাঙ্গা ট্রাক টার্মিনালে। এখন সেই বাজার থেকেই সামান্য মালামাল কিনে শীত, রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে গল্লামারীর ব্যস্ততম সড়কের পাশে বসেই সবজি বেচেন নুর জাহান। রাতে থাকেন গল্লামারীর একজনের বাড়ির বারান্দা।
খুলনা মহানগরীর চারটি প্রধান প্রবেশদ্বারের অন্যতম গল্লামারী। প্রতিদিন এ প্রবেশদ্বার দিয়ে নগরীতে যাতায়াত করে কয়েকশ যানবাহন। গল্লামারী বাজার আর ব্রিজ একই স্থানে হওয়ায় এ সড়ক পার হতে গেলে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। শুধু নুরজাহান নন, তার মতো অসহায় পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এখানে ব্যবসা করতে বসেছেন রাহিলা বেগম (৬০), তাসলিমা বেগমসহ (৫৮) বেশ কয়েকজন নারী। সবজি বেচেই চলে তাদের টিকে আছে তাদের জীবন।
রাহিলা বেগম বলেন, স্বামী আর দুই ছেলে নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু রোগে পড়ে স্বামী আজ বিছানায় পড়ে আছেন। বড় ছেলেটাও মারা গেছেন চার-পাঁচ বছর আগে। ছোট ছেলেটা পড়াশোনা করছে। তার পড়াশোনার খরচ আর স্বামীর চিকিৎসার জন্যই তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে সব আরাম আয়েশ।
রাহিলা বেগম বলেন, আমি থাকি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায়। সেখান থেকে প্রতিদিন রাত ৩টার দিকে চলে আসি নগরীর ট্রাক টার্মিনাল পাইকারি কাঁচা বাজারে। সেখান থেকে কমদামী মালামাল কিনে বসে পড়ি গল্লামারী ব্রিজের সংযোগ সড়কে। রাত ৮-৯টা অবধি বেচাকেনা করি। রাতে কোনো একটা গাড়ি ধরে আবার চলে যাই ডুমুরিয়া।
এখানের অপর ব্যবসায়ী সেলিনা বেগম (৫৫)। স্বামী আর সতিনের অত্যাচারে আজ পাগল প্রায় অবস্থা তার। সেলিনা জানান, আরেক বিয়ে করেন তার স্বামী। স্বামী আর সতিনের অত্যাচারে এক সময় পাগল প্রায় হয়ে যান তিনি। এক পর্যায়ে সব হারিয়েছেন তিনি। অবশেষে ঠাঁই হয় গল্লামারী ব্রিজের পাশে। অন্য নারীর মতোই বেছে নিয়েছি ব্যবসা। অর্থের অভাবে অনেক সময় সবজি কিনতে পারি না, তখন মাঠঘাট থেকে শাক তুলে বিক্রি করি।
এখান থেকে নিয়মিত সবজি কেনেন সরকারি চাকরিজীবী আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ অসহায় নারীদের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু কিনি। গল্লামারী এ বাজার অনেক বড়। এখানে অনেক ধনী ব্যক্তিরাও আসেন বাজার করতে। কিন্তু অসহায় এ মানুষগুলোর দিকে তারা ফিরেও তাকান না। এদের কাছেও মাঝে মধ্যে খুব ভালো সবজি পাওয়া যায়। দামও থাকে সাধ্যের মধ্যে। তাই তাদের কাছ থেকে কেনা মানে হলো একটু হলেও তাদেরকে সহায়তা করা। সেই কারণেই তিনি তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনে থাকেন।
এসজে/এএসএম