হাটে আর দেখা মেলে না ভ্রাম্যমাণ চুল কাটার দোকান
এক সময় গ্রামীণ হাটে দেখা মিলতো ভ্রাম্যমাণ নাপিতের। মোড়া কিংবা কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো পিঁড়িতে বসে চুল কাটাতেন মানুষ। পাশ ঘিরে চুল কাটানোর অপেক্ষায় থাকতেন আরও অনেকে। মেতে উঠতেন খোশগল্পে। তবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য।
এখন প্রতিটি হাটেই গড়ে উঠেছে সেলুনের স্থায়ী দোকান। ছোট-বড় যে ধরনের সেলুন হোক না কেন আছে বিশাল আয়না, চেয়ার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সাজগোজের প্রসাধনী। কিছু কিছু সেলুনে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও।
মে দিবসে নীলফামারীর জলঢাকা, চাপানি কৈমারীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ হাটে ভ্রাম্যমাণ চুল কাটার দোকানের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় এ অঞ্চলের হাটবারে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতেন নরসুন্দররা। শুধু হাটেই নয় গ্রামে গ্রামে ঘুরেও মানুষের চুল কেটে দিতেন অনেকে। গ্রামের মানুষ অপেক্ষায় থাকতো কবে আসবে নরসুন্দর। এলেই একে একে চুল কাটাতেন এক পাড়ার একাধিক মানুষ।
দিন দিন মানুষ বাজারমুখী হওয়া ও উন্নতভাবে কাটানোর অভ্যাস গড়ে তোলায় চাহিদা কমেছে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের। আগে বিভিন্ন হাটে যেসব স্থানে দেখা মিলতো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের, এখন সেসব স্থানে গড়ে উঠেছে বাহারি নামের সেলুন। বছর তিনেক আগেও ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের দেখা গেছে। কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না।
জলঢাকার বিজলির ডাঙ্গা এলাকায় নরসুন্দেরের কাজ করেন বালাগ্রামের শান্ত। দাদার হাত ধরেই এ পেশায় আসা তার। তার দাদা কুলো বর্মন এক সময় বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে চুল কাটতেন।
শান্ত বলেন, ২০১৫ সালে দাদা মারা গেছেন। এর আগে দাদা গ্রামে ঘুরে ঘুরে চুল কাটতেন। আমিও দাদার সঙ্গে যেতাম। তখন ছোট ছিলাম। আমি ২০১৮ সালে দোকান দিয়েছি এখানে। মানুষজন এখানেই চুল কাটতে আসেন।
নীলফামারীর উকিলের মোড় এলাকার নরসুন্দর বাবুল বলেন, এক সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা এ কাজ করতেন। মানুষ হাটে কম আসতো। তাই গ্রামে গেলে অনেক মানুষ পাওয়া যেত। এখন সবাই আধুনিক জিনিস খোঁজে। সব কিছু পরিপাটি প্রয়োজন।
গোলমুন্ডা এলাকার সফিয়ার রহমান বলেন, আগে নরসুন্দররা বাড়িতে বাড়িতে এসে আমাদের চুল কাটাতো। পরিবারের সব ছেলে চুল কাটতাম। আমাদের সন্তানদের চুলও ছোটবেলায় ওই নরসুন্দররা এসে কাটতো। তবে এখন আসে না। আমরাও বাজার গেলে দোকানে গিয়ে কেটে আসি।
বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা অভিনন্দন কালচারাল একাডেমির নির্বাহী পরিচালক কাঞ্চন রায় জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। আগের নরসুন্দররা বা এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল তারা নিম্ন আয়ের বলতে পারেন। একদম দারিদ্র্যতার সর্বনিম্ন স্তরের। যখন তাদের হাতে টাকা এলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলো, তারা নিজস্ব দোকান দিয়ে বসলো। এভাবেই মূলত ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের দৃশ্য বিলীন হচ্ছে। মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ পরিবেশগতভাবে ভালো কিছু প্রত্যাশা করবে এটাই স্বাভাবিক।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক অবিনাশ রায় জাগো নিউজকে বলেন, মূলত মঙ্গা কাটতে থাকায় দিন দিন মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ আর নিচে বসে চুল কাটতে চান না। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষরাও এখন নির্দিষ্ট একটি স্থানে অবকাঠামো গড়ে বসেছেন। মানুষ সেখানে গিয়েই চুল কাটছে। সময়ের পরিক্রমায় দিন দিন এটি আরও ব্যতিক্রম হবে।
তিনি আরও বলেন, আগে কাঁচি, চিরুনি খুর দিয়ে কাজ করতেন। এখন আধুনিক জিনিস দিয়ে কাজ করছে নাপিতরা। মূল কথা নিম্ন আয়ের মানুষরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া ও মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলেই আগের দৃশ্যপট চোখে পড়ে না।
রাজু আহম্মেদ/এসজে/জিকেএস