নতুন কর্মজীবনে লঞ্চের হকাররা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০১ মে ২০২৩
সিরাজ ব্যাপারীর চায়ের দোকান-ছবি জাগো নিউজ

সিরাজ ব্যাপারী (৪০), বনাজী ঔষধের ব্যবসা করতেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের একসময়ের ব্যস্ততম মাঝিকান্দি লঞ্চঘাটে। প্রতিদিন দক্ষিণ অঞ্চলের একাংশ মানুষ এই রুট দিয়ে পাড় হতেন। সে সময় বনাজী ঔষধ বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই এখানে লঞ্চে কোনো যাত্রী আসে না। তাই বনাজী ঔষধ তেমন বিক্রি হয় না।

দীর্ঘ ২৫ বছর এই ব্যবসা করে তিনি ১০ লাখ টাকা সঞ্চয় করেন। শেষমেশ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সেই অর্থও খরচ হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে সিরাজ ব্যাপারী তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের পেছনে ছুটে চলেছেন। একটি এনজিও থেকে দেড় লাখ টাকা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মাঝিরঘাটে দিয়েছেন চায়ের দোকান। মাসে দোকান ভাড়া ৮০০ টাকা। দোকান থেকে দিনে ৭০০-১০০০ টাকা আয় করেন। এই উপার্জনে তার ছয় সদস্যের পরিবার মোটমুটিভাবে চলে যাচ্ছে। এক ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী।

প্রায় দুই যুগের ব্যস্ততম ঘাট এখন নিস্তব্ধ। পদ্মার তীরে অলস হয়ে পড়ে আছে লঞ্চঘাটের পন্টুন। ২০২২ সালে ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে যানজট নিরসনের জন্য এই রুটে একটি ফেরিঘাট নির্মাণ করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই সময় শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি লাইনে ৯টি ফেরি চলাচল করতো। আর ২০টি লঞ্চ চলতো এ রুটে। গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই এ ঘাটে লঞ্চ-স্পিড বোট ফেরিসহ ছোটবড় সব নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তারপরই মাঝিরকান্দি লঞ্চঘাটটি সুনসান এবং যাত্রীশূন্য হয়ে পড়ে। এ ঘাটের আশেপাশের এলাকা দরিদ্র পরিবারে প্রায় ১০০ হকার ছিল। সেতু উদ্বোধনের পর তাদের মধ্য কিছু সংগ্রামী ব্যক্তির বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিবর্তন ও বদলেছে জীবনযাত্রার মান। এখন কেউ কেউ ভ্যানগাড়ি দিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন কেউবা অটোভ্যানে যাত্রী পারাপার ও কেউ চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

মাঝিরঘাটে ঘুরে দেখা যায়, ইসুব সরকার (৪৭) ভ্যান গাড়িতে করে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। দোকানে ভালোই বেচাকেনা। তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে লঞ্চে ঝালমুড়ি বিক্রি করেছি। তবে সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই লঞ্চ বন্ধ হয়ে যায়। ঘাটে কোনো যাত্রী বা লোকজনের ভিড় নেই। তাই লঞ্চে বেচাকেনা করতে পারি না। লঞ্চ থাকলে বেশি বেচাকেনা হতো। এখন ভ্যানে স্কুলে স্কুলে এবং বিভিন্ন বাজারে ঝালমুড়ি বিক্রি করছি। তবে লঞ্চের তুলনায় এখন ঝালমুড়ি বিক্রি করে মোটামুটি ভালোই আছি। এক ছেলেকে কলেজে। দুই মেয়েকে মাদরাসায় পড়ালেখা করাচ্ছি। আমাদের এখানে এক থেকে দেড়শ হকার ব্যবসায়ী ছিল। কেউ ভ্যান গাড়ি, কেউ কাঁচামালের দোকান, কেউ চায়ের দোকান কেউবা ঢাকায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করছে।

আরও পড়ুন>>> অটো চালানোকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন সাহিদা

দেখা হয় লঞ্চে ১০ বছরের দই বিক্রেতা আব্দুল খালেকের সঙ্গে। লঞ্চঘাটের আশেপাশেই ঘুরছিলেন তিনি। বলেন, লঞ্চে দই বিক্রি করে মোটামুটি আয় করে পরিবার নিয়ে ভালোই ছিলাম। সেতু চালু হওয়ার পরে আমাদের লঞ্চঘাটে মানুষও আসে না আর লঞ্চ নেই। উপায় না পেয়ে বিক্রমপুরে চলে যাই। সেখানে গিয়ে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে অটো চালাই। মাসের মধ্যে ১৫-২০ দিন অটো চালাই আর দশ দিন নিজের গ্রামের বাড়ি থাকি। তবে সেতু হওয়ায় আমাদের দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে এটাই যথেষ্ট। আমরা একটা না একটা করে চলতে পারবোই। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

দেখা হয় স্পিডবোট ব্যবসায়ী রমজান মাদবরের সঙ্গে। তিনি বলেন আমরা ভালোই ছিলাম এই ঘাটে স্পিডবোটের ব্যবসা করে। এখন আমাদের ঘাটে কোনো যাত্রী আসে না। তবে আমাদের এখানে স্পিডবোট অনেকেই বিক্রি করে অন্য ব্যবসা করছেন। কেউ কেউ অন্য ঘাটে গিয়ে স্পিডবোটের ব্যবসা করছেন। আমার স্পিডবোট তিনটি। কী ব্যবসা করবো সেই বিষয়ে এখনো পরিকল্পনা নিতে পারিনি। আশা আছে এগুলো বিক্রি করে মাইক্রোবাস কিনব। পদ্মা সেতু হয়েছে এখন মাইক্রোবাস কিনে গাড়ির ব্যবসা করতে পারবো। এক বছর ধরে বেকার। এখন একটা ছোট লোন করবো এবং এই স্পিডবোটগুলো বিক্রি করে মাইক্রোবাস কিনবো। ঘাট বন্ধ হয়েছে তাতে কি হয়েছে; পদ্মা সেতু হওয়ায় আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

jagonews24ভ্যানচালক নাসির হাওলাদার-ছবি জাগো নিউজ

লঞ্চে ঝালমুড়ি বিক্রেতা এখন ভ্যানচালক নাসির হাওলাদারের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে লঞ্চে ঝালমুড়ি বিক্রি করে ভালোই কাটতো দিন। এখন লোন করে একটা ভ্যানগাড়ি কিনেছি। মোটামুটি ডালভাত খেতে পারছি। আগে ইনকাম হতো ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা; এখন ইনকাম হয় ৫০০-৬০০ টাকা।

এছাড়া কয়েক হাজার দোকান ও হোটেল ব্যবসায়ী ছিল এই ঘাটে। এখন সেই হোটেল ব্যবসায়ীদের দেখা যাচ্ছে না। এখন সর্বোচ্চ ২০টি হোটেল ব্যবসায়ী টিকে রয়েছেন এ ঘাটে। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। নেই মানুষজনের তেমন ভিড়। ঘাট থেকে পদ্মা সেতু সাড়ে ৩ কিলোমিটারের রাস্তা। অনেকে পদ্মা সেতুর ঢালে জাজিরার গোল চত্বরে গিয়ে দোকান দিয়েছেন। অনেক হকার বাসে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন। কেউবা বাসের হেলপারের চাকরি করছেন।

পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. লাল চান মাদবর বলেন, এক সময়ের ব্যস্ততম লঞ্চঘাট আজ সুনসান অবস্থায় পড়ে আছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর আগে থেকে এই মঙ্গল মাঝের ঘাটে একটি ফেরিঘাট করা হয়। ফেরিঘাট আর লঞ্চঘাট মিলিয়ে ভালোই ছিল এখানকার সাধারণ ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা। এখানে প্রায় এক দেড়শর মতো হকার ছিল। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই এই ঘাটে কোনো যাত্রী নেই, লঞ্চ পারাপার হয় না। ফেরিও চলে না। তাই এখানকার হকার ব্যবসায়ীরা এখন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ চায়ের দোকান, কেউ কেউ ভ্যান এবং কেউ অটোরিকশাসহ বাসের হেলপারের চাকরি করছেন। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে এই পদ্মা সেতু হওয়ায়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।

আরও পড়ুন>> কৃষিশ্রমিকরা এখন শহর-প্রবাসমুখী

বিআইডব্লিউটিসি মাঝিরকান্দি ফেরিঘাট ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) প্রসুল্ল চৌহান বলেন, ঈদের আগে ১৮ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে আমরা মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য ফেরি চালু করেছিলাম। পরে ২০ এপ্রিল পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল পারাপারের অনুমতি দেওয়ায় আবার ফেরি বন্ধ। এখন ফেরিগুলা নির্দিষ্ট স্টেশনে পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয় জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান সোহেল বলেন, দেশের বৃহত্তম প্রকল্প দেশের দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকা যাওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল মঙ্গলমাঝির লঞ্চঘাট ও ২০২২ সালে নির্মিত একটি ফেরিঘাট। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে লঞ্চঘাটে কোনো যাত্রী আসে না। তাই এই ঘাট দুটি অকেজো হয়ে পড়েছে। এখানকার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়েছিল। এখন কেউ চায়ের দোকান, কেউ ভ্যান গাড়ি ও কেউবা ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করছেন। সেতু হওয়ায় যে ঘাটের মানুষ কর্মহীনতায় ভুগবে তা কিন্তু নয়। তারা খুব কম সময়ে ঢাকায় যেতে পারছে। আবার আগের থেকে ভালো কাজ খুঁজে নিচ্ছে। পদ্মা সেতু হওয়ায় জাজিরায় অনেক গার্মেন্ট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউজ হচ্ছে। সেখানেও তারা কাজ করতে পারবে।

এসএইচএস/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।