প্রযুক্তির আধুনিকায়ন

কৃষিশ্রমিকরা এখন শহর-প্রবাসমুখী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, ০১ মে ২০২৩
মাঠে ধান কাটছেন একদল শ্রমিক-ছবি জাগো নিউজ

রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার তৌহিদ, পারিবারিকভাবেই গৃহস্থ। তারা চার ভাই। বাবার সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে। বর্তমানে কমেছে সম্পত্তি। আগে পরিবারে ছিল রাখাল, কিষান ও কাজের লোক। এখন সেগুলো নেই। মূলত জমি কমা ও কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণেই কমেছে কৃষি শ্রমিক।

তৌহিদ বলেন, যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি আমার বাবার বাড়িতে প্রায় ১০০ গরু ছিল। সেগুলো চরানো ও লালন পালনের জন্য তিনজন লোক ছিল। বাবা মারা গেছে, এরপর আমাদের জমিও ভাগ হয়ে গেছে। কমেছে সবকিছু। এখন আর বাড়িতে নির্ধারিত কাজের লোক নেই। যখন প্রয়োজন পড়ে দরকারে ভাড়া করা লোক দিয়েই চলে। এছাড়া এখন তো সবকিছুই প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়। তাই লোকেরও দরকার কম পড়ছে।

তৌহিদের মতো রাজশাহী অঞ্চলে কমছে গৃহস্থ পরিবার। মূলত পরিবার বেড়ে যাওয়া ও ছোট ছোট আকারে ভাগ হওয়ার করণেই গৃহস্থ পরিবার কমছে। এ কারণে কমেছে গৃহস্থ কর্মচারীও। সারা বছর আর কেউ কাজ করে না। এদিকে, প্রযুক্তির কারণে কমেছে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা। বছরজুড়ে কাজ না থাকায় কৃষি শ্রমিকরা ছুটছে শহরে অথবা প্রবাসে।

রাজশাহীর কাকনহাট এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ। এবার ৮ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের জন্মলগ্ন থেকেই গৃহস্থ পরিবার। এখনও আছে। তবে আগের মতো কৃষক নেই। আগে বাড়িতে সব সময় লোক থাকতো। এখন তো আর কাজে লোক দরকার তেমন হয় না। মূলত সারা বছর লোক রাখার প্রয়োজন পড়ে না। তাই অনেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন>>> অটো চালানোকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন সাহিদা

তিনি বলেন, মূলত কৃষি যন্ত্রপাতির আধুনিকায়নের কারণে কৃষিশ্রমিক কম লাগছে। তাই কৃষিশ্রমিকরা ছুটছে শহরে কিংবা বিদেশে। আমার পরিবারে যে ছেলেটা থাকতো এখন সে বিদেশে কাজ করে। এভাবে কৃষিশ্রমিক হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সময়ে কৃষিশ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে।

রাজশাহী শহরে রিকশা চালান মো. শিশির। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছর আগে তিনি একটি গৃহস্থ পরিবারে কাজ করতেন। সারা বছরে তেমন আয় হতো না। তাই সেই কাজ ছেড়ে তিনি এসেছেন শহরে। এখন রিকশা চালান। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। সেই আয় দিয়েই চলে সংসার।

শিশির বলেন, আগে তো যে আয় ছিল সেই আয় দিয়ে পরিবার কোনোমতো চলতো। এখন জিনিসপত্রের যে দাম তাতে কৃষিকাজ করলে সারা বছর চলাই দায়। এখনও খুব কষ্টেই দিন কাটে।

রাজশাহীর একটি মেসে রান্নার কাজ করেন সাদেকা বেওয়া। তিনি বলেন, বাড়িতে কৃষিকাজ করলে শুধু খাবার দিতো। এখানে খাবারের পাশাপাশি কিছু টাকাও মিলছে। আর আগের মতো কৃষিবাড়িও নেই। মানুষ এখন ছোট ছোট ভাগে সংসার করছে। তাই আমরা শহরে চলে এসেছি। এখানে স্বামী কাজ করে আমিও কাজ করি। একসাথে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে।

রাজশাহী জনশক্তি ব্যুরোর তথ্য মতে, রাজশাহী থেকে বিদেশগামীদের একটি বড় অংশ কৃষিশ্রমিক। মূলত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো রাজশাহীর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তারা কৃষিকাজের জন্য চলে যাচ্ছে। বিদেশে বেশি অর্থ ও চাহিদার কারণে এই পথে ঝুঁকছেন কৃষি শ্রমিকরা। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এ অঞ্চলের অন্তত সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের সিংহভাগই কৃষক।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো রাজশাহী সহকারী পরিচালক মোহা. আব্দুল হান্নান বলেন, মূলত কৃষিক্ষেত্রে এখন শ্রমিক নিচ্ছে মালয়েশিয়া। তবে এর বাইরে কৃষিশ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। এ কারণে বাংলাদেশে অনেক কৃষিশ্রমিক কমে যাচ্ছে। আমাদের মাধ্যমে চলতি বছরের শুরু থেকে সাড়ে ৬ হাজার মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এদের বেশিরভাই কৃষিশ্রমিক।

আরও পড়ুন>> কৃষিশ্রমিকরা এখন শহর-প্রবাসমুখী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের প্রফেসর আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিদেশ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা আমাদের সবার আছে। অনেকেই দক্ষ শ্রমিক না হলেও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দালালদের প্ররোচনায় যাচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত বেকারও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে এগুলো থেকে বের করতে পারবো না। মাঝে মাঝে দেখছি প্রবাসে অনেক ভোগান্তি। মারা যেতেও দেখছি। তবে এটি থেমে নেই।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে দক্ষ শ্রমিক নেই। বিশেষ করে কৃষিশ্রমিক নেই। একটা সময় গ্রুপ ধরে ধান কাটে আসতো। এখন বিদেশ গেলে অনেক টাকা, এমন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায়। যার কারণে এটি আর নেই। এটি থেকে বের হতে হবে। এটার জন্য সরকারি বা এনজিও দিয়ে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। তারপরও এটি থেকে সহজে যে বের হয়ে আসা যাবে বলে আমার কাছে মনে হয় না।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিদেশে যাওয়া যাবে না এটা নয়। দক্ষ শ্রমিক যাবে। জনশক্তি রফতানি এটা আমাদের সোর্স। তবে যে কেউ চলে যাবে, এতে তারাও যেমন সমস্যায় পড়ছে আমারও সমস্যায় পড়ছি। আমাদেরও শ্রমিক দরকার। আমাদের যে শ্রমিক দরকার সেটি বুঝতে হবে। দেশে কাজ নেই তাতো নয়। কিন্তু সেটা কেউ চিন্তাও করছে না। এগুলো নিয়ে ভাবলেই এ সমস্যা থেকে সমাধান মিলবে।

সাখাওয়াত হোসেন/এসএইচএস/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।