ভয়ংকর বশিকপুর

কাজল কায়েস কাজল কায়েস , জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: ০৮:০৪ এএম, ২৯ এপ্রিল ২০২৩
প্রতীকী ছবি

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন বশিকপুর। অনেকে বলেন, ‘খুনোখুনির এলাকা’। তুচ্ছ ঘটনা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায় এ ইউনিয়নে। গত ২৫ বছরে এখানে খুন হয়েছে ২৪ জন। তারা সবাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তাদের গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

সবশেষ মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) রাতে বশিকপুর বাজার এলাকায় যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান (৩৫) ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। নোমান জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং রাকিব জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মদদে দীর্ঘদিন ওই ইউনিয়নে লাগামহীন সন্ত্রাস চলছে। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৮ সালে প্রকাশ্যে দফাদার আবুল বাশারের পায়ে প্রথম গুলি করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জিহাদী। সেই থেকে শুরু। একই বছর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাবুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে চলছে ধারাবাহিক সন্ত্রাস-নৈরাজ্য। একে একে হত্যা করা হয় ২৪ নেতাকর্মীকে।

আরও পড়ুন: অপরাধে জড়াচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা

গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বশিকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি আলাউদ্দিন পাটওয়ারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট হত্যা করা হয় ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদকে। ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর ঘুমন্ত অবস্থায় যুবলীগ নেতা মোরশেদকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০১৫ সালের ১৭ জুন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উল্যাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২১ মার্চ গাছে বেঁধে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় চাটখিলের আওয়ামী লীগ নেতা ব্যবসায়ী গোলাম মাওলাকে।

২০১৬ সালের ২৫ মে প্রকাশ্যে স্থানীয় বিএনপি নেতা সহোদর ইসমাইল হোসেন হোসেন চৌধুরী ও ইব্রাহিম হোসেন রতনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ৫ আগস্ট হত্যা করা হয় ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. ফয়সালকে।

Fire-3.jpg

বশিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। ঘরে-রাস্তায় কারোর নিরাপত্তা নেই। ১৯৯৮ সালের শুরু হওয়া সন্ত্রাস এখনো চলছে। ২৪ জনের জীবন গেছে। অনেকেই পঙ্গু হয়েছেন। কারা সন্ত্রাস করছেন, কে বাহিনী পরিচালনা করছেন, কারা তাদের গডফাদার সবাই তা জানে। আমরা এসব থেকে মুক্তি চাই। স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই।’

আরও পড়ুন: দাবদাহে লবণ শিল্পে বাজিমাত

নোমান ও রাকিব হত্যাকাণ্ডে আবুল কাশেম জিহাদীকে দায়ী করছে ভুক্তভোগী পরিবার। জিহাদী চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি নিজের নামে বাহিনী গঠন করে এলাকায় দুই যুগ ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা বশিকপুর ও আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, অপহরণ, দখলসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।

জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান বলেন, ‘নোমান ও রাকিবের স্বজনরা ঘটনার পর থেকেই কাশেম জিহাদীকে দায়ী করছেন। দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য নিয়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপিকে এ ঘটনায় ফাঁসাতে চাচ্ছে। এরআগে আলাউদ্দিন হত্যার ঘটনায় আমাদের নেতাকর্মীদের জড়ানো হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় বিএনপির কোনো নেতাকর্মীই জড়িত নয়।’

নিহত নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাশেম জিহাদী ছাড়া আমাদের কোনো শত্রু নেই। তিনিই আমার ভাই ও রাকিবকে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভাই হত্যার বিচার চাই।’

আরও পড়ুন: ‘লাল ফিতায়’ বন্দি নোয়াখালী বিমানবন্দর

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমার সঙ্গে পরাজয়ের পর থেকে বিভিন্ন সময় কাশেম জিহাদী হুমকি দিয়ে আসছিলেন। পরিকল্পিতভাবেই আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৮ সালের পর থেকে বশিকপুরে যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সবগুলো কাশেম জিহাদীই ঘটিয়েছেন। কাশেম জিহাদী আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, তিনি আমার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলবেন। তিনি নাকি জেলে থাকলেও বাঘ, বাইরেরও বাঘ। তিনি চেয়ারম্যানি চাইলে আমি দিয়ে দিতাম। আমার ভাইকে সে খুন করে ফেলেছে।’

নিহত রাকিবের বাবা রফিক উল্যাহ বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনের পর থেকেই জিহাদী আমার ছেলেকে হুমকি দিয়ে আসছে। গতবছরের ২০ ডিসেম্বর পোদ্দার বাজার কায়েকোবাদ অডিটোরিয়ামে প্রকাশ্যে মারধর করেছে। পা ভেঙে দিয়েছে। তখন মামলা দিতে চাইলে পুলিশ নেয়নি। আমার ছেলেকে জিহাদীই হত্যা করেছে। নির্বাচনে তার বিরোধিতা করাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।’

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত আবুল কাশেম জিহাদীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। নোমান-রাকিব হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি এলাকায় নেই বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: গ্যাস সংকটে ব্যাহত বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের উৎপাদন

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, একসময় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সন্ত্রাসী মাছুম বিল্লাহ ওরফে লাদেন মাছুম বাহিনী বশিকপুর, দত্তপাড়া, করপাড়া ও আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। তার বাহিনীতে উঠতি বয়সের ২০০-২৫০ জন সক্রিয় সদস্য ছিল। তাদের হাতে থাকতো বিপুলসংখ্যক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। প্রায়ই প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোলাগুলি, খুনোখুনি করতেন তারা। তাদের অপহরণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, লুটপাটে অতিষ্ঠ ছিল ওই অঞ্চলের মানুষ। বিএনপিসমর্থিত আরেক সন্ত্রাসী মোরশেদ বাহিনী ছিল। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

২০১৫ সালের ১৬ জুন বালাইশপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উল্যাকে কুপিয়ে ও গুলি করে এবং পরের বছরের ১৩ আগস্ট যুবলীগ নেতা মো. ফয়সালকে হত্যা করে লাদেন মাছুম বাহিনী। এসব ঘটনায় তখন মামলাও হয়েছিল। আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে লাদেন বাহিনী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

Fire-3.jpg

পুলিশ জানায়, হত্যা, অস্ত্র, ডাকাতিসহ ২৮ মামলার আসামি লাদেন মাছুমের গুলিবিদ্ধ মরদেহ ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয়। তখন কালা মাসুদ-শাহাদাত বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লাদেন মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে বিপুলসংখ্যক অবৈধ আগ্নােয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন: ২৯ বছর ধরে প্লেন ওড়ে না কুমিল্লা বিমানবন্দরে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন ইউপি সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, লাদেন নিহত হলেও তার বাহিনীর সদস্যরা এখনো এলাকায় সক্রিয়। তাদের হাতে থাকা কোনো অস্ত্র এতদিনেও উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বশিকপুরের বাসিন্দা কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে একে একে বশিকপুরেই ২৪ খুন হয়েছে। এছাড়া অন্তত ১২-১৫ জন এখনো পঙ্গু। কেউ পা, কেউ হাত, কেউ চোখ হারিয়েছে। কঠোরভাবে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। এখানের বাসিন্দারা ২৪ ঘণ্টায়ই ভয়ে থাকেন, কখন কী ঘটে।’

চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই। আমরা কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই না। দোষীদের গ্রেফতারে প্রশাসনকে আহ্বান করছি। কাশেম জিহাদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করা হবে।’

আরও পড়ুন: রোজা ও গরমে বাজিমাত/বরগুনায় ৩ হাজার কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, ‘একের পর এক হত্যাকাণ্ডে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে বিপুল অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। সন্ত্রাসীর পরিচয় শুধুই সন্ত্রাসী। যে দলেরই হোক, সন্ত্রাসীর কোনো ছাড় নেই।’

জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে নোমান ও রাকিবকে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) রাত পৌনে ১০টার দিকে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় সন্ত্রাসীরা যুবলীগ নেতা নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিবকে গুলি করে। এরআগে নোমান পোদ্দার বাজারে ছিলেন। তার সঙ্গে থাকা অন্যদের বিদায় দিয়ে তিনি রাকিবকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে নাগেরহাটের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে নাগেরহাটের কাছাকাছি পৌঁছালে তাদের গুলি করা হয়। মাথায় ও মুখে গুলিবিদ্ধ হয়ে নোমান মারা যান। গুলিবিদ্ধ রাকিবকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা নেওয়ার পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন: বগুড়ার ‘সাদা সোনা’ যাচ্ছে বিদেশে

নিহত নোমান সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি প্রস্তাবিত জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নিহত রাকিব বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ও একই ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের রফিক উল্যার ছেলে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের জেলা সভাপতি মাইন উদ্দিন পাঠান জাগো নিউজকে বলেন, সন্ত্রাসরোধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কমিটমেন্ট প্রয়োজন। তাদের গণমুখী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জানান দিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘বশিকপুরের অনেক মানুষ ভয়ে ঢাকা এবং লক্ষ্মীপুর শহরে থাকেন। প্রবাসীরা দেশে এলেও লক্ষ্মীপুরে বাসা ভাড়া থেকে আবার বিদায় নেন। এলাকায় যেতে পারেন না।’

প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য এম আলাউদ্দিন বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানাই। তা নাহলে শুধু বশিকপুর নয়; শিগগির পুরো লক্ষ্মীপুরই অশান্ত হবে।

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।