প্রবাসী-বহিষ্কৃত-সরকারি চাকরিজীবীদের ঠিকানা কমলনগর আ’লীগ

কাজল কায়েস কাজল কায়েস , জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: ০৭:১১ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২৩

সম্মেলনের ১০ মাস পর লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বরিশাল সিটি করপোরশেনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন কোম্পানিকে সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়। তিনি ৪০-৫০ বছর ধরে সেখানেই ব্যবসা করে আসছেন। কমিটিতে চারজন বহিষ্কৃত, চারজন প্রবাসী ও চার সরকারি চাকরিজীবীকে পদ দেওয়া হয়েছে।

সিনিয়র ত্যাগী কয়েকজনকে কমিটিতে রাখা না হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভাই-স্ত্রী পদ পেয়েছেন। এনিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

সম্মেলনের দিন কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ও জেলার শীর্ষ নেতারা ১৩টি সম্পাদকের পদ ঘোষণা করেছিলেন। এদের মধ্যে তিনজনকে রাখা হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে। এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের নাম সাদা কালি দিয়ে মুছে স্বীকৃত রাজাকারের সন্তানের নাম কলমে লিখে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, গতবছরের ১২ মে কমলনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। হাজিরহাট উপকূল সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে কাউন্সিলরদের ভোটে নিজাম উদ্দিন সভাপতি ও একেএম নুরুল আমিন রাজু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন সহ-সভাপতি, সহ-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩ জনের নাম ও পদ উল্লেখ করে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সম্মেলনের ১০ মাস পর মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু ও সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করেন।

দলের ১৮ নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভাপতির ভাই ব্যবসায়ী মোতাহের হোসেনকে কমিটির তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, স্ত্রী নার্গিস আক্তারকে সদস্য করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রী শিরিন আক্তার মুক্তাও সদস্য। প্রবাসী মুছা কলিম উল্যা লিটন, কামাল উদ্দিন চৌধুরী, মাইন উদ্দিন সবুজ ও আকাশকে সদস্য করা হয়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কৃত আশরাফ উদ্দিন রাজন রাজু, ফয়সল আহমেদ রতন, ডালিম কুমার শ্রীপদ ও ইসমাইল হোসেন মেম্বারকে সদস্য করা হয়েছে।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘন ১৯৭৯-এর ২৫ ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে বা কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণেণ্ড অংশগ্রহণ বা কোনো প্রকারেই সহযোগিতা করতে পারবেন না।

অথচ নোয়াখালী সদরের পূর্ব আন্ডারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, কাদির পন্ডিতেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, চরশাহী জনতা ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক আবদুস সহিদকে সদস্য, ফেনী জেলা আদালতের প্রধান তুলনাকারক জিয়া উদ্দিন ফারুক ও সিলেটের চাকরিজীবী হেলাল উদ্দিন হিমেলকে সদস্য করা হয়।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিরাজ হোসেন শান্ত বলেন, ‘আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার পরিবারের সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকাররা হত্যা করেছে। কম্পোজ করা অনুমোদিত কমিটির ৭০ নম্বর ক্রমিকে সদস্য পদে আমার নাম ছিল। টাকার বিনিময়ে সাদা কালি দিয়ে মুছে কলম দিয়ে চিহিৃত রাজাকারের ছেলে এ কে এম রাশেদ বিল্লাহর নাম বসানো হয়েছে। বিষয়টি আমি সিনিয়র নেতাদের জানিয়েছি।’

মধ্যম সারির আওয়ামী লীগের তিন নেতা জানান, কমিটিতে স্বজনপ্রীতি ও পরিবারতন্ত্র হয়েছে। কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন কোম্পানি বরিশালের ব্যবসায়ী। তিনি ৩০-৪০ বছর আগে কমলনগর ছেড়ে গেছেন। ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় পদ বিক্রি করা হয়েছে।

সাবেক যুবলীগ নেতা মাহবুবুর রহমান বাবলু ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটিতে আমাকে শ্রমবিষয়ক সম্পাদক রাখা হয়েছিল। সম্মেলনের দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমার নাম ঘোষণা করেন। কিন্তু এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আমি নেই।’

উপজেলা তরুণ লীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক প্রবাসী তারেক সুমন বলেন, ‘আমার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে। টাকা না দেওয়ায় কমিটিতে আমার জায়গা হয়নি। টাকা চাওয়ার কল রেকর্ড আছে।’

উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন বাপ্পি বলেন, ‘কমিটিতে দলের ত্যাগী-দুর্দিনের অনেক নেতার নাম নেই। আছে বিএনপি-জামায়াত নেতা, প্রবাসী, চাকরিজীবী। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যা ইচ্ছা তাই করছেন।’

কমলনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নুরুল আমিন মাস্টার বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে অন্তত ৩০ জনের কাছে পদ বিক্রি করা হয়েছে। যে বেশি দিয়েছে, তাকে ভালো পদে রাখা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের কোনো নির্দেশনা মানা হয়নি।’

জানতে চাইলে কমলনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমার স্ত্রীসহ ছয় নারীকে কমিটিতে রেখেছি। তারা রাজনীতিতে সক্রিয়। বহিষ্কৃত ও বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে। এ কারণে আমরা তাদের কমিটিতে রেখেছি। কোনো টাকার লেনদেন হয়নি।’

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি বলেন, অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ঈদের পরে বসবো। তবে বিতর্কিত নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, সম্মেলনের দিন ঘোষিত যে তিন নেতার নাম বাদ পড়েছে, তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিনিয়রদেরকে বাদ দেওয়াসহ অন্য অভিযোগ লিখিতভাবে জানালে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।