বাঁশি তৈরির গ্রাম দেবীপুর

আব্বাস আলী
আব্বাস আলী আব্বাস আলী , জেলা প্রতিনিধি নওগাঁ
প্রকাশিত: ০৭:১৫ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০২৩

‘বাঁশি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত নওগাঁ সদর উপজেলার দেবীপুর গ্রাম। সারা বছরই বাঁশি তৈরি হয় সেখানে। বৈশাখের বিভিন্ন মেলাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ গ্রামের কারিগররা।

কারিগররা বলছেন, বছরে দেবীপুর গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কোটি পিস বাঁশি উৎপাদন হয়। যার উৎপাদন খরচ ৩০ কোটি টাকা হলেও পাইকারি মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এবার বৈশাখে উৎপাদন হবে প্রায় দুই কোটি টাকার বাঁশি। আগামীতে বাঁশি রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

নওগাঁ শহর থেকে উত্তরে তিন কিলোমিটার দূরে তিলকপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রাম। গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে রাস্তার দুইপাশে বাঁশি তৈরির উপকরণ নলের গাছ। গ্রামের ২০০ পরিবার বাঁশি তৈরির সঙ্গে জড়িত। এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাসিন্দারা। ৫২ বছর আগে এ গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত আলেক মণ্ডলের হাত ধরে বাঁশি তৈরির যাত্রা শুরু হয়। এরপর গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এ কাজ।

বাঁশি তৈরির গ্রাম দেবীপুর

আরও পড়ুন: ফেলে দেওয়া কলাগাছে লাখ টাকা আয়

প্রথমে ক্ষেত বা জমি থেকে বাঁশি তৈরির প্রধান কাঁচামাল নল কাটা হয়। পরে এগুলো পরিষ্কার করে সাইজ মতো কেটে রোদে শুকিয়ে অন্তত ১৫ ধাপে তৈরি হয় বাঁশি। বাঁশি তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন নারীরা। পুরুষরা বাজারজাত করেন। প্রতিটি বাঁশি তৈরিতে (সাধারণ/সাদা বাঁশি) উৎপাদন খরচ পড়ে ১ টাকা ৫০ পয়সা। যা পাইকারিতে বিক্রি হয় ২ টাকা পিস। বাঁশির সৌন্দর্য বাড়াতে বেলুন ও রঙিন কাগজ (জরি) পেঁচিয়ে উৎপাদন খরচ পড়ে ৫ টাকা ৫০ পয়সা। যা পাইকারিতে বিক্রি হয় প্রতি পিস ৬ টাকা ৫০ পয়সা।

খুচরা পর্যায়ে সাদা বাঁশি বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকা এবং রঙিন বাঁশি ১৫-২০ টাকা পিস। বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরাও দেবী গ্রাম থেকে বাঁশি কিনে যান। এ গ্রামের নারীরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বাঁশিতে রঙিন কাগজ জড়িয়ে বাড়তি আয় করেন।

কারিগররা জানান, রঙিন বাঁশি তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ সীমিত হয়েছে। চলতি বছর রঙিন জরির (কাগজ) দাম কেজিতে ২০০ টাকা বেড়েছে। ৮০০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। এক কেজিতে চার হাজার পিস বাঁশি পেঁচানো যায়। টেপ (আঠা) লাগে ২০টি। প্রতি পিসের দাম ১৩ টাকা। সাদা জরির দাম ৭০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা কেজি। ১৬০ টাকার এক প্যাকেট বেলুন এখন ২২০ টাকা।

বাঁশি তৈরির গ্রাম দেবীপুর

আরও পড়ুন: বাতাস হলেই বুক কাঁপে হাওরের কৃষকের

বাঁশির কারিগর গৃহবধূ রহিমা বেগম বেগম বলেন, ‘সংসারে কাজের পাশাপাশি বাঁশিতে জরি পেঁচানোর কাজ করি। প্রতি হাজার বাঁশিতে জরি ও বেলুন লাগানো মজুরি ১৬০ টাকা। দুই দিনে এক হাজার টাকার কাজ করা যায়।’

প্রায় ৩০ বছর ধরে বাঁশি তৈরির সঙ্গে জড়িত বাচ্চু মণ্ডল। নিজের জমি না থাকায় অনেক দূর থেকে নল কিনে এনে বাঁশি তৈরি করেন। এ বছর প্রায় ৮০-৯০ হাজার পিস তৈরি করবেন।

বাচ্চু মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, খুলনা ও সিলেট থেকে পাইকার এসে এসব বাঁশি কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় কুরিয়া সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কখনো কখনো নিজেও বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন। এবার বৈশাখ ও ঈদ উপলক্ষে প্রায় ২০ হাজার পিস বাঁশি তৈরি করা হবে। যা থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন তিনি।

বাঁশি তৈরির গ্রাম দেবীপুর

আরও পড়ুন: কাপ্তাই হ্রদে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্নে

৫০ বছর ধরে বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা ৭৩ বছরের আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, মামা আলেক মণ্ডলের হাত ধরেই এ গ্রামে বাঁশির কাজ শুরু হয়। সেসময় প্রতিটি বাঁশির দাম ছিল ২৫ পয়সা। এখন দুই টাকা পিস। সারা বছর বাঁশি তৈরি হলেও বৈশাখে বাঁশির চাহিদা বেড়ে যায়। বৈশাখের বিভিন্ন মেলাকে কেন্দ্র করে এবার ১৫ হাজার পিস বাঁশি বিক্রি করার ইচ্ছা তার।

পাইকারি ক্রেতা খলিল বলেন, ‘এ বছর বৈশাখে হচ্ছে রমজান মাসে। এ মাসে ঈদ। এতে আনন্দের মাত্রা আরও একধাপ বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেলা ও রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করে এ একমাসে দেবীপুর গ্রাম থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার বাঁশি উৎপাদন হবে।’

নওগাঁ বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, বাঁশি তৈরির উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তারা যদি কোনো ধরনের সহযোগিতা নিতে চান তাহলে দেওয়া হবে। নারীদের জন্য পাঁচ শতাংশ ও পুরুষদের জন্য ছয় শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হবে।

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।