মৃত ব্যক্তির বয়স্ক ভাতা তুলছেন সন্তানরা
মৃত ব্যক্তিদের বয়স্ক ভাতা তুলছেন তাদের সন্তান ও স্বজনরা। বছরের পর বছর মৃত ব্যক্তির তথ্য গোপন করেই সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে এমন ডজনখানেক নাম পাওয়া গেছে।
মূলত কোনো ভাতাভোগী মারা গেলে তার মৃত্যুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয়কে জানানোর কথা থাকলেও সেই দায়িত্ব পালন করেছেন না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ফলে বর্তমানে প্রকৃত বয়স্কদের বছরের পর বছর অসহায়ত্বের জীবন কাটাতে হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত ভাতাভোগীরা।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরসেন্সাস ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সিডু গাজীর কান্দির বাসিন্দা মৃত হাসেম বয়াতী (৭৫)। তিনি তিন বছর আগেই মারা গেছেন। অথচ প্রতি বছর তার ভাতার ৬ হাজার টাকা উত্তোলন করে আসছেন তার ছেলে নাসির বয়াতী।
মৃত হাসেম বয়াতির মোবাইল নম্বরে কল দিলে তার ছেলে নাসির বয়াতী রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক আগেই। আমরা ৫-৬ বার ভাতা পেয়েছি। এখন আর আসে না।’
ভেদরগঞ্জ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মৃত কাদির তপদার। তিনি মারা গেছেন মাস আগেই। তবে এখনো তার ভাতা ভোগ করছেন মেয়ে খালেদা বেগম। এ ছয় মাস তিনিও মৃত বাবার বয়স্ক ভাতা তুলেছেন।
মৃত কাদির তপদারের মোবাইল নম্বরে কল দিলে তার মেয়ে খালেদা বেগম রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মারা গেছে সাত মাস আগে। আমরা এপর্যন্ত একবার ভাতা তুলেছি। আর তুলিনি।’
রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কোড়ালতলী গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুল জলিল সরদার (৭৫)। তিনি এক বছর আগে মারা যান। তবে তার ভাতা কার্ড ব্যবহার করে মেয়ে সিমা বেগম টাকা তুলছেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা মিয়াচান ব্যাপারীর ভাতাও তুলছেন তার স্বজনরা।
এরকম মহিষার ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিশিদ পাইক (৬৯), মোহাম্মদ আলী সরদার (৭০), আবু তাহের হাওলাদার (৭২) ও ইব্রাহীম হাওলাদার (৭৫) ছয়মাস বা বছরখানেক আগেই মারা গেছেন। তবে তাদের ভাতা এখনো চলমান আছে।
এদিকে একই ওয়ার্ডে মকবুল হাওলাদার ও মালেক হাওলাদারের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলেও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মিলছে না বয়স্কভাতা কার্ড।
শরীয়তপুর জেলা ৬৪টি ইউনিয়ন ও ৬টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। একটি ওয়ার্ডেই যদি চারজন মৃত ব্যক্তির ভাতা আত্মসাৎ করা হয়, তাহলে প্রাথমিকভাবে আনুমানিক গড় হিসাব করা যায় ৭০টি পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলিয়ে জেলায় ২ হাজারেরও বেশি মৃত ব্যক্তির বয়স্কভাতা সরকার ভুলবশত দিয়ে যাচ্ছে। এতে শরীয়তপুর জেলায় সরকারের ১০ কোটি টাকার বেশি প্রতি বছর বিফলে যাচ্ছে।
জেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকার ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ব্যক্তিদের বয়স্ক ভাতা, স্বামী হারানো নারীদের বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা ও গর্ভবতী মায়েদের দিচ্ছে মাতৃত্বকালীন ভাতা। পাশাপাশি মাসে মাসে চালও দিচ্ছে। কয়েকবছর আগেও ভাতা পেতে সরকারি অফিসের ও ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো। এখন আর সেই পদ্ধতিতে নয়, মোবাইল ব্যাংকিং নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ভাতা দেওয়া হয়। তবে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার পরবর্তী তিন মাসের ১৫০০ টাকা তোলা যাবে। পরে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যান ওই মৃত ব্যক্তির মৃত্যুসনদ নিয়ে উপজেলা সমাজসেবা দফতরে জানানোর নির্দেশনা আছে।
মহিষার ইউনিয়নের বাসিন্দা বয়স্কভাতা প্রত্যাশী মগবুল হাওলাদার (৬৭) বলেন, ‘আমরা তো এ দেশের নাগরিক না মনে হয়। তা না হলে কি করে মরে গেছে সেই ব্যক্তি ভাতা পায়। আমরা সারাবছর ঘুরেও ভাতার কার্ড করাইতে পারলাম না। আমি ওষুধ কিনতে পারছি না। সরকারের প্রতি অনুরোধ আমাকে যেন শেষ বয়সে কিছু সহযোগিতা করে।’
সত্তরোর্ধ্ব মালেক হাওলাদার শেষ বয়সে এখন কুজো হয়ে হাঁটছেন। তিনি বলেন, ভাতার টাকা আমরা বেঁচে থাকতে পামু না মনে হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন আমারে যেন বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন।’
মৃত ব্যক্তির ভাতার বিষয়ে ভেদরগঞ্জ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার শহীদ হাওলাদার বলেন, কাদির তপদার অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। তবে বয়স্কভাতার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এখন ভাতা পায় কি না তাও জানি না। আপনি পৌরসভার আলম ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন।
মহিষার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী অরুন হাওলাদার বলেন, আমি মেম্বারদের দায়িত্ব দিয়েছি এগুলো যাচাই করে আমাকে জানাতে। বিষয়টি আমি আপনার কাছেই শুনলাম। তারা মৃত হয়ে ভাতা পাবে তা হয় না। আমি আজই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ বিষয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি আপনার কাছেই শুনলাম। তবে আমরা সব সময়ই বয়স্ক ভাতাভোগীদের ব্যাপারে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের বলা আছে, কোনো ভাতাভোগী মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাছে সেই ব্যক্তির মৃত সনদ দিতে।
তিনি আরও বলেন, জরুরি সভা ডেকে বিষয়টি সমাধান করা হবে। অবৈধভাবে মৃত বাবার নামে বয়স্কভাতা তুললে তদন্ত সাপেক্ষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ বৈদ্য জাগো নিউজকে বলেন, মৃত ব্যক্তির পরবর্তী তিনমাসের ভাতা একবার তুলতে পারবে। কিন্তু এরপর তিনি ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত নয়। মেম্বার চেয়ারম্যানরা আমাদের না জানালে কী করে জানবো মারা গেছে। আমাকে কিছু তথ্য দিলে বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসজে/জেআইএম