শত বছরের ঐতিহ্য রডবিহীন পাগলা বড় জামে মসজিদ
শত বছরের ঐতিহ্য সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলার রায়পুর গ্রামের পাগলা বড় জামে মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি যে কারোর নজর কাড়বে। দোতলা এ মসজিদের বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কোনো রড ব্যবহার করা হয়নি। সম্পূর্ণ ইটের ওপর নির্মিত স্থাপনাটি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ আশ্বিন (শুক্রবার) মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বড় মসজিদের নির্মাণকাজে মূল কারিগররা ছিলেন ভারতীয়। মূল স্থপতির নাম মুমিন আস্তাগার। যার পূর্বপুরুষ ভারতের তাজমহলে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। মসজিদটি নির্মাণ করতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে।
মসজিদটির মোট উচ্চতা ৪০ ফুট। ছয়টি স্তম্ভের ওপর ছয়টি মিনার। তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট সাইজের আরও ১২টি মিনার রয়েছে। ভূমিকম্পনিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত পাতের ওপর ভিত নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে অনেকগুলো বড় মাপের ভূমিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি। মসজিদ নির্মাণের পর বড় ধরনের কোনো সংস্কারেরও প্রয়োজন পড়েনি। মসজিদের ভেতরকার দৃশ্য আরও বেশি নান্দনিক। মসজিদে নামাজের জন্য নির্ধারিত মূল স্থান দোতলায়।
মেহরাব অংশে জমকালো পাথর কেটে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় ডিজাইন। পুরো মসজিদের চারপাশে তিন ফুট উচ্চতার যে কারুকার্যখচিত টাইলস লাগানো হয়েছে তা উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়। টাইলসগুলো আনা হয়েছিল ইতালি ও ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে।
মসজিদের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের স্লিপার। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়। দোতলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর। তখনকার অবিভক্ত ভারতের সঙ্গে নদীপথের যোগাযোগ সহজ ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মসজিদটি নদীর কূলঘেঁষে নির্মিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জা দুই ভাই মিলে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। বেশ বিত্তবান এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন তারা। বিপুল জমির মালিকও ছিলেন।
ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জার বাবা আদিল হাজি ছিলেন বেশ ধার্মিক। তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিসহ হাতেগোনা দু-একজন হাজি ছিলেন। আদিল হাজিকে সবাই পায়ে হেঁটে হজপালনকারী হিসেবে জানতেন। ধর্মকর্মের প্রতি অগাধ মনোনিবেশ থেকে তিনি নিজ বাড়িতে একটি টিনশেড মসজিদ তৈরি করেন। সেসময় ওই এলাকায় এটিই ছিল প্রথম মসজিদ। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন। পরে পাগলা বড় জামে মসজিদটি নির্মাণ করেন ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জা।
সিলেট বিয়ানীবাজার থেকে আসা পর্যটক হুমায়ুন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক মসজিদটি দেখতে এসেছি। এখানে নামাজ আদায় করলাম। সত্যিই অসাধারণ একটি মসজিদ এটি।’
সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার থেকে আসা হেদায়েত ইসলাম বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাগলা মসজিদের কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি। আজ নিজ চোখে দেখলাম। দৃষ্টিনন্দন মসজিদটিকে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় নেওয়া উচিত।’
মসজিদের উদ্যোক্তা ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জার প্রপৌত্র লালন মির্জা ও শ্যামল মির্জা। তারা জাগো নিউজকে বলেন, মসজিদটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। আমরা চাই এটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নেওয়া হোক।’
শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, পাগলা বড় জামে মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে মহাসিং নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি একটি ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। আমি যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম তখন এটি আমাদের পাঠ্যবইয়ে ছিল। মসজিদটি আমাদের ইতিহাসের জানান দেয়।
এসআর/জিকেএস