‘উপহারের ঘর কিনে নিয়েছি’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলী ইউনিয়নের কাউন্সিলর মোড়ের পাশে খাস জমিতে গত ২২ বছর ধরে বসবাস করছিলেন ভূমিহীন এত্তার-গুধি দম্পতি। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে চুড়ি বিক্রি ও গরু-ছাগল পালন করেই মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামীকে নিয়ে সংসার চালান গুধি। তবে কিছুদিন আগে হঠাৎ করে খবর আসে তার ঘরের সরকারি খাস জমিতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ করা হবে। তাই তার ঘরটি ভেঙে ফেলা হবে।
এতে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গুধির কপালে। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে দৌড়াতে শুরু করেন। তাদের কাছে জানতে পারেন, তার ঘরের জায়গাটিতেই নির্মাণ করা হবে ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। আকলিমা বেগম গুধিকে সেখানেই ঘর দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন ইউপি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট নারী ইউপি সদস্য। কিন্তু এজন্য দিতে হবে নগদ অর্থ। পরে আকলিমা বেগম গুধি ধারদেনা করে কয়েক দফায় প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন চেয়ারম্যান ও নারী ইউপি সদস্যকে। এমনকি চেয়ারম্যানের চাহিদা মেটাতে হাঁস-মুরগিও দিয়েছেন। তবে এতকিছু দিয়েও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাননি তিনি।
ভোলাহাট উপজেলার কাউন্সিলর মোড় এলাকায় গিয়ে জানা যায়, আকলিমা বেগম গুধিই শুধু নয়, দলদলী ইউনিয়নের পুরাতন বাড়ইপাড়া চুড়িয়ালী মোড়ে এমন অনেকের কাছেই বিভিন্ন পরিমাণে টাকা নেয়ার পরেও দেওয়া হয়নি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। এমনকি যারা ঘর পেয়েছেন তাদের কাছেও নেওয়া হয়েছে ১০ থেকে ৭০ হাজার পর্যন্ত টাকা। এছাড়া প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, ঘরের মেঝেতে মাটি ভরাট করে দেওয়ার কথা থাকলেও সুবিধাভোগী পরিবারগুলোকে দিয়েই তা করানো হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আরজেদ আলী ভুট্টু এবং সাবেক সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য আজিনুর বেগম এসব টাকা নিয়েছেন। এছাড়া ঘরে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ করছেন সুবিধাভোগীরা। তারা বলছেন, নিয়ম মেনে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়নি।
আকলিমা বেগম গুধি বলেন, গত ২২ বছর আগে এখানে প্রথম ঘর নির্মাণ করেছিলাম। তখন আমি চুড়ির ব্যবসায় করতাম। তাই এই জায়গার নাম হয়ে যায় চুড়িআলীর মোড়। ভালোই ছিলাম। কিন্তু কিছুদিন আগে চেয়ারম্যান-মহিলা মেম্বার আমাকে উঠিয়ে নতুন ঘর দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু দিতে হবে টাকা। তাই সুদের ওপর টাকা নিয়ে মহিলা ইউপি সদস্য আজিনুরকে একবার পাঁচ হাজার ও পরে তিন হাজার টাকা দিয়েছি। এর আগে চেয়ারম্যান আরজেদ আলী ভুট্টুকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। এর পাশে আমার মেয়ে-জামায়ের বাড়ির সামনে একটি টিনের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস করছি। জামাইকে বলেছিলাম, আমার উপহারের বাড়ি নির্মাণ হলেই চলে যাব। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। তারা টাকা নিয়েও আমাকে বাড়ি দিলো না। এখন জামাইয়ের বকা খাচ্ছি আর থাকছি।
তিনি আরও বলেন, রেজিস্ট্রি করা বাবদ পরেও দুইবার টাকা নিয়েছে। বাড়িতে থাকা দুইটা পাতিহাঁস নিয়ে গেছে পিকনিকের কথা বলে। এমনকী পিকনিকের কথা বলে একটি রাজহাঁসও দাবি করে। পরে টাকা ধার করে এক হাজার ১০০ টাকায় একটি রাজহাঁস কিনে চেয়ারম্যানকে দিয়েছি। টাকা দেওয়ার পরে বারবার চেয়ারম্যান-মহিলা মেম্বারের কাছে ঘুরেও কোনো সুরাহা হয়নি। ঘর তো দেয়নি, এমনকী টাকাও ফেরত দেয়নি।
আনারুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি চুরিয়ালী মোড়ে উপহারের ঘর পেয়েছেন। এজন্য দিয়েছেন ৬৩ হাজার টাকা। এ টাকা ঋণ নিয়ে চেয়ারম্যানকে দিয়েছেন। এখন ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় বাড়িতে থাকতে পারছেন না। টাকা পরিশোধের জন্য ঢাকায় কাজে গিয়েছেন স্ত্রীকে নিয়ে।
আনারুল ইসলামের মেয়ে মোসা. নিলুফা খাতুন বলেন, আরজেদ আলী ভুট্টু চেয়ারম্যানকে আমরা ৬৩ হাজার টাকা দিয়ে ঘর পেয়েছি। কিন্তু কাছে টাকা ছিল না, তাই ঋণ করে টাকা দিতে হয়েছে। এতে পথে মা-বাবা বসেছেন। তাই তারা টাকা রোজগারে ঢাকায় গেছেন। আমরা এখন নিঃস্ব। ৬৩ হাজার টাকা পরিশোধ হলেই মা-বাবা বাড়ি ফিরবে।
প্রতিবন্ধী ছেলের জমানো টাকা দিয়েও ঘর পাননি আমেনা বেগম। তিনি বলেন, আমাদের জায়গা-জমি কিছুই নেই। পরের জমিতে বাস করি। প্রতিবন্ধী ছেলের জমানো টাকা তিন দফায় ১৮ হাজার দিয়েছি ভুট্টু চেয়ারম্যানকে। রেজিস্ট্রির কথা বলে আরও এক হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু বাড়ি পাইনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মৃত মো. দিলজান আলীর স্ত্রী ফিকি বেগম বলেন, খাস জমিতেই বাস করছিলাম। কিন্তু আমাকে তুলে দিয়ে সেখানে উপহারের ঘর তৈরি করা হচ্ছিল। ওই জায়গায় বাড়ি পেতে অনেকেই নাকি টাকা দিচ্ছে শুনে চেয়ারম্যানের বাড়িতে দুই-তিন দিন যাই। পরে চেয়ারম্যান বলেন, আমি তোমার বাড়ি ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি। যে টাকা দিতে পারবে তার বাড়ি। তাই প্রথমে নারী ইউপি সদস্য আজিনুর বেগমের হাতে ৫০ হাজার দিয়েছি। পরে আজিনুর জানায়, এতে হবে না। আরও ১০ হাজার লাগবে, ওটা আমি খাবো। পরে তাকেও ১০ হাজার টাকা দিই। এরপরে ঘর পেয়েছি।
আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া সাইদুল ইসলামের স্ত্রী ফুলবাস বেগম বলেন, আমরা ভূমিহীন। কোনো জায়গা-জমি নেই। তাই চুড়িয়ালী মোড়ের এই সরকারি খাস জমিটি ভরাট করে বসবাস করছিলাম। পরে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ শুরু হলে আমাদের বলে ঘর কিনে নিতে হবে। তা শুনে কান্নাকাটি করে বেড়াতাম। কারণ, এত টাকা কোথায় পাব? আর টাকা না দিলে ঘরও পাব না। তাই উপায় না পেয়ে বাড়িতে থাকা সব হাঁস, মুরগি, ছাগল বিক্রি ও ধারদেনা করে ৫০ হাজার টাকা আরজেদ আলী ভুট্টু চেয়ারম্যানকে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে পেয়েছি। এক কথায় উপহারের ঘর আমরা কিনে নিয়েছি।
নূর নাহার বেগম নামে আরেক নারী বলেন, ঘর নির্মাণের সময় মিস্ত্রীদের কাছে শুনলাম টাকা না হলে ঘর পাওয়া যাবে না। পরে চেয়ারম্যানকে বললাম, আমি গরিব মানুষ, টাকা দিতে পারব না। তাতেও রাজি না হওয়ায় ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার পর ঘর পেয়েছি।
একই এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-১ এ ঘর পেয়েছেন আলিম উদ্দিন-সাবানা খাতুন দম্পতি। জমি আছে ঘর নেই, এ প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী ঘর তৈরিতে সব অর্থ সরকারি বরাদ্দে হওয়ার কথা থাকলেও ৮০-৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান সাবানা খাতুন। তিনি বলেন, এই ঘর তৈরি করে দিতেই মহিলা মেম্বার আজিনুর বেগমকে ৬৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এমনকী ঘরের ভেতর ভরাটও করতে হয়েছে নিজের টাকা দিয়ে।
তবে দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য আজিনুর বেগম টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি রেজিস্ট্রি হওয়ার সময় তাদের (সুবিধাভোগী) সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করেছিলাম মাত্র।
আর এ বিষয়ে দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আরজেদ আলী ভুট্টু বলেন, চুরিয়ালী মোড়ের সরকারি খাস জায়গায় মোট ১৭টি বাড়ি ছিল। পরে সেসব ঘর ভেঙে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ১৯টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়। শুরুর দিকে ঘর তৈরির সময়ে আমি ছিলাম। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর বরাদ্দ দেওয়ার সময়ে নির্বাচন চলে আসে এবং আমার পা ভেঙে যায়। তাই শেষ পর্যায়ের কাজের কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। স্থানীয় ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন। তবে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমি জানি না।
তিনি আরও বলেন, পরে আরও ৫০টি বাড়ি তৈরি ও হস্তান্তর করা হয়। এসবের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ভোলাহাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কাউছার আলম সরকার। আমরা জেনেছি, এই প্রকল্পে ঘরের ভরাট কাজও সংযুক্ত রয়েছে। কিন্তু তা ঘর পাওয়া ব্যক্তিদের দিয়েই করিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাহলে এ বাবদ সরকারি বরাদ্দ গেলো কোথায়? পিআইও এই প্রকল্পের সদস্য সচিব। তার নিয়ন্ত্রণেই সবকিছু হয়েছে। আমার ধারণা, তিনি এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ভোলাহাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কাউছার আলম সরকার বলেন, এর আগে চুরিয়ালী মোড়ের যারা ঘর পেতে টাকা দিয়েছেন তাদের ডাকা হয়েছিল। এমনকী দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আরজেদ আলী ভুট্টুকেও ডাকা হয়েছিল। তবে আরজেদ আলীর সামনে তারা টাকা দেওয়ার কথা বলতে পারেননি। আর ইউএনও আছেন, ডিসি আছেন আপনি তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন।
তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে তাবাসসুম। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবো না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছি। অভিযুক্ত সাবেক চেয়ারম্যান আরজেদ আলী ভুট্টুর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআরআর/জিকেএস