বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
ঘোষণার ১৫ বছরেও গ্রামের নাম হয়নি ‘হামিদনগর’
ঝিনাইদহ শহর থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ধরে ১৫ কিলোমিটার পথ গেলে কালীগঞ্জ শহর। এ শহর থেকে কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর হয়ে চুয়াডাঙ্গা সড়ক ধরে সাত কিলোমিটার গেলে সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরের খালিশপুর বাজার। এ বাজার পার হয়ে ডান দিকের পাকা সড়ক ধরে মাত্র তিন কিলোমিটার এগোলেই কপোতাক্ষ নদের কূলঘেঁষে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ি।
গ্রামটির নাম খর্দ্দ খালিশপুর। ২০০৮ সালে গ্রামের নাম ‘হামিদনগর’ ঘোষণা করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
গ্রামটিতে গিয়ে দেখা গেলো, তিন কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের জন্য বাড়িটি নির্মিত হচ্ছে। ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগের অধীন ২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর বাড়িটির কাজ শুরু করেন স্থানীয় এক ঠিকাদার। বাড়ির প্রতিটি ফ্লোরে থাকবে দুটি ইউনিট। বাড়ির চারপাশে প্রাচীরসহ থাকছে আলাদা গেস্টরুম ও গার্ডরুম।
বাড়িটি পেয়ে খুশি বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার। এরআগে এরশাদ সরকার একতলাবিশিষ্ট একটি ঘর করে দেয়। এটি নষ্ট হয়ে গেলে দীর্ঘদিন ধরে টিনশেডের বাড়িতে বসবাস করে আসছিল শহীদ হামিদুর রহমানের পরিবার।
চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর সেজ ভাই শুকুর আলী মারা যান। এর দুবছর আগে স্ট্রোক করে মারা যান ছোট ভাই ফজলুর রহমান। ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান মা কায়দাছুন্নেছা। এখন জীবিত আছেন একমাত্র ভাই হামজুর রহমান ও দুই বোন। তবে বর্তমানে হামজুর রহমান কথা বলতে ও চলাফেরা করতে পারেন না।
প্রতিমাসে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে ৩৫ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয়। এছাড়া জাতীয় যেকোনো দিবসে বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়ে পরিবারের পাঁচজনকে বিশেষ সম্মানি দেওয়া হয়।
বীরশ্রেষ্ঠের তিন ভাই প্রত্যেকের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। এরমধ্যে মেজ ভাই হামজুর রহমানের ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্ররিয়ান পদে কর্মরত। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। বাকিরা সবাই মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। এছাড়া বীরশ্রেষ্ঠের ছোট ভাই ফজলুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন সুলতানা সরকারি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজের অফিস সহকারী পদে কর্মরত।
২০০৮ সালের ৯ মার্চ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সিআর দত্ত। জাদুঘর উদ্বোধনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল গ্রামের নাম ‘হামিদনগর’ ঘোষণা দেন। কিন্তু আজও তা কাগজে-কলমে কার্যকর হয়নি।
কথা হয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ভাতিজা হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। জানালেন পরিবারের অতীত, বর্তমান, সুখ-দুঃখ আর মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা।
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার চাচা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তার অনেক স্বপ্ন ছিল তার পরিবার, তার গ্রামের লোক যেন মোটা চালের ভাত আর মোটা কাপড় পরে মাথা উঁচু করে বসবাস করতে পারে। কারণ আমার চাচা অত্যন্ত গরিব ঘরের সন্তান। তিনি মাত্র পঞ্চম শ্রেনি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। দরিদ্রতার কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। পরিবারের লোকসংখ্যা ছিল সাতজন।’
‘দাদার অবস্থা ভালো না থাকাই চাচাকে কৃষিকাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তখন চাচা কৃষিকাজ করতে করতে জানতে পারলেন সেনাবাহিনীতে লোক নেবে। আমার চাচা তখন অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে মার্চের গণহত্যা দেখে তিনি সহ্য করতে পারেননি। সেখান থেকে চলে আসেন গ্রামে। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২৮ অক্টোবর তিনি ধলাই সীমান্তে জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে দেশের মাটির জন্য শাহাদতবরণ করেছিলেন।’
আক্ষেপ করে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে চাচা যুদ্ধ করেছিলেন আমি বলবো সেই স্বপ্ন এখনো অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি। দরিদ্রতার কারণে ভাইবোনগুলো লেখাপড়া করতে পারেননি। কৃষিকাজেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন আমার দাদা-দাদি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবনের অনেক কষ্টের কথাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে আমার পরিবারের জন্য, আমার নিজের জন্য অনেকবার একটা চাকরি চেয়েছি। অনেক দপ্তরে গিয়েছি কিন্তু চাকরি পাইনি। সবশেষ কমিউনিটি ক্লিনিকের জমিদাতা হিসেবে একটি চাকরি চেয়েছিলাম। সেটাও দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার পরও চাকরি পাইনি।’
বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের দাবি, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজ ও স্মৃতি জাদুঘরের পাশে সরকারের ৩৭ বিঘা খাস জমি রয়েছে। কপোতাক্ষ নদের তীরঘেঁষে এই জমিতে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ইকো পার্ক তৈরি করার দাবি জানান তারা।
বীরশ্রেষ্ঠের ফলক ও মায়ের নামে অসঙ্গতি
জাদুঘরের সামনে স্থাপিত বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের বিশালাকৃতির ফলকের নিচে জন্ম সাল ১৯৫৩ উল্লেখ করা হলেও মাস ও দিন উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ে শহীদ হামিদুরের জন্মতারিখ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ লেখা হয়ে আসছে।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে জাদুঘরের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জীবনীসম্বলিত আরও একটি বিশালাকৃতির ফলক। যেখানেও এ বীরশ্রেষ্ঠের শুধু জন্ম সালই লেখা হয়েছে। মায়ের নামেও বানান ভুল।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর (প্রস্তাবিত হামিদনগর) গ্রামে শহীদ হামিদুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে তার মায়ের নাম লেখা রয়েছে ‘কায়দাছুন্নেছা’। অথচ জাদুঘরের ফলকে লেখা হয়েছে ‘কায়ছুন নেছা’। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং মাদরাসা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ে লেখা হয়েছে ‘কায়সুননেসা’।
ফলকে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনীতে লেখা হয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুর রহমান। বাবার নাম আক্কাছ আলী মন্ডল। মা কায়ছুন্নেছা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তাদের পরিবার যশোরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খোর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন হামিদুর রহমান। পরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই এলাকায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ২৮ অক্টোবর রাতে ধলইয়ের যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করে এলএমজি চালনারত অবস্থায় শত্রুপক্ষের দুজনকে ঘায়েল করেন। এসময় গুলিতে তিনি শাহাদতবরণ করেন।
এ বীরসৈনিকের মরদেহ ধলই থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত আমবাসা এলাকায় একটি মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকার আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে নিয়ে এসে ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করে বাংলাদেশ সরকার।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রথীন্দ্র নাথ রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমে জানলাম। আজতো ছুটি, আগামীকাল অফিস আছে। এ বিষয়ে কালই আমি ওখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সঠিক নাম যাচাই-বাছাই করে একটা ব্যবস্থা নেবো।’
এসআর/জেআইএম