কৃষক সেন্টু হাজংয়ের সাফল্য

জীর্ণ কুটিরেই ২৩ জাতের ধান উদ্ভাবন

ইমরান হাসান রাব্বী ইমরান হাসান রাব্বী , শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:৩৫ পিএম, ২১ মার্চ ২০২৩

শেরপুরের নিভৃত পল্লীর কৃষক সেন্টু হাজং। উদ্ভাবন করেছেন ২৩ জাতের নতুন ধান। এরই মধ্যে তার উদ্ভাবিত ধান চাষ করে সফলতা পেয়েছেন স্থানীয় কয়েকশো কৃষক। তাই জেলার বিভিন্ন বাজারে এসব জাতের চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সেন্টু চন্দ্র হাজং (৪৮) ব্রিডিং সংকরায়ণ পদ্ধতিতে নিজ হাতেই উদ্ভাবন করছেন নতুন জাতের দেশি ধান। ফলে এলাকায় তিনি কৃষক থেকে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। দেশব্যাপী তার নতুন জাতের ধান ছড়িয়ে দিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চান স্থানীয়রা।

আরও পড়ুন- ২০ কোটি টাকার সেতু আছে, সংযোগ সড়ক নেই

জরাজীর্ণ বাড়িতেই দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ধান নিয়ে গবেষণা করছেন কৃষক সেন্টু হাজং। অভাবের কারণে এসএসসির পর লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া এই মানুষটিই উদ্ভাবন করেছেন ২৩ জাতের নতুন দেশীয় ধান। আমন মৌসুমে মাটির গুণাগুণ ধরে রাখতে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে তিনি ছয় একর জমিতে দেশি জাতের ধান আবাদ করেছেন।

জীর্ণ কুটিরেই ২৩ জাতের ধান উদ্ভাবন

এছাড়াও দেশি জাতের ধান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হতে চলেছে যেমন- বগি, হালই, গোলাপী, মালঞ্চি, ময়নাগিড়ি, মালসিরা, অনামিয়া, পারিজাত, আপচি, কাইশাবিন্নি, মারাক্কাবিন্নি, শংবিন্নি, দুধবিন্নি, বিরই, চাপাল, খাসিয়াবিন্নিসহ বিভিন্ন আমন জাতের ধান বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রতি বছর নিজের এক একর জমিতে ট্রায়াল করে লাগান তিনি। ট্রায়ালের জন্য নিজের ছয় একর জমিতে গোবর সার ও নিজের তৈরি কেঁচো কম্পোস্ট সার দিয়ে সেন্টু শাইল, চিনিশাইল, তুলসিমালা, পাইজাম, ঢেপা, চাপাল, পুরাবিন্নি ও নেদরাবিন্নি ধান নিয়ে গবেষণা করছেন।

ধান গবেষণার জন্য তিনি ব্রিডিং বা সংকরায়ণ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। প্রথমবার একটি নতুন জাতের ধান আবিষ্কার করতে তার সময় লাগে প্রায় ৭ বছর। নিজের আবাদি জমিতে ৩৭০টি প্লটে ট্রায়াল প্লট তৈরি করে সারা বছর চলে তার ধান গবেষণা। এ বছর কয়েকটি নতুন জাত আবিষ্কার করা হলেও সেন্টু-২৩ চিকন ও সরু আতপ দেশি জাতের ধান বাজারজাত করেছেন তিনি। নিজে কৃষক হওয়ায় বেশ আনন্দ ও তৃপ্তি নিয়ে কাজ করেন সেন্টু হাজং।

২০০৫ সালে স্থানীয় একটি এনজিওর (কারিতাস) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন গবেষণা। সাত বছরের চেষ্টায় উদ্ভাবন করেছিলেন ‘সেন্টু শাইল’ নামের নতুন ধান। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে ও কৃষকদের কাছে ব্যাপক চাহিদা এই ধানের। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই নিয়মিত ধান নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন তিনি। স্থানীয় বাজারে চাহিদা বাড়লেও সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতি মেলেনি দীর্ঘদিনেও।

জীর্ণ কুটিরেই ২৩ জাতের ধান উদ্ভাবন

আরও পড়ুন- নড়বড়ে সেতু পার হওয়াই ভয়

সেন্টু হাজং বলেন, দেশি জাতের ধান এমনিতেই কমে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই কারোরই। যে কয়টা দেশি জাত আছে তার বেশিরভাগেই পোকার আক্রমণ কম হয়। জৈবসার ব্যবহারের ফলে ধানের উৎপাদন খরচও কম পড়ে। অন্যদিকে কেঁচো কম্পোস্ট ও গোবর সার ব্যবহার করাতে ধানের গাছ শক্ত ও মজবুত হয়। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা উঁচু হলেও হেলে পড়ে না। একটু আধটু পোকার আক্রমণ হলে নিমপাতা, গোলঞ্চপাতা ও বাসকপাতা পানিতে ফুটিয়ে তারপর মেশিনের সাহায্যে জমিতে স্প্রে করি। জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ধানের উৎপাদন খরচও কম পড়ে। এসব দেশি জাতের ধান ভালো হলে একরে ৪০ থেকে ৫০ মণ হারে উৎপাদন হয়।

তিনি আরও বলেন, দেশি জাতের ধানের আছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এসব ধানের ভাত, পিঠাপুলি, মুড়ি বা খাবারে আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়। তিনি চান দেশি জাতের ধানগুলো যেন বিলুপ্ত না হয়ে যায়। আর নতুন নতুন জাতের ধান আবিষ্কার করতেও তার অলসতা নেই।

সাধারণ ধানের তুলনায় সেন্টু ধানের ফলন প্রায় দ্বিগুণ। কম খরচে অধিক লাভ পাওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার উদ্ভাবিত এসব জাত। চলতি বছর সরু আতপ জাতের সেন্টু- ২৩ ধানে দ্বিগুণ লাভ পেয়েছেন কৃষকরা। নতুন জাত ছড়িয়ে দিতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা।

কৃষক আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, আমি এ বছর আমার ৫ একর ১৫ শতাংশ জমিতে সেন্টুর আবিষ্কার করা আতপ সেন্টু-শাইল জাতের ধান আবাদ করেছিলাম। শুকিয়ে একর প্রতি ৫০-৫৫ মণ হারে ফলন পেয়েছি। প্রতি একরে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। সেন্টু-শাইলের বর্তমান বাজার দর ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা প্রতি মণ।

জীর্ণ কুটিরেই ২৩ জাতের ধান উদ্ভাবন

আরও পড়ুন- শেরপুরে দখল হচ্ছে বনভূমি, উজাড় হচ্ছে গারো পাহাড়

একই এলাকার অপর কৃষক আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি এবার ৩ একর ১০ শতাংশ জমিতে সেন্টু-পাইজাম ধান লাগিয়েছিলাম। শুকিয়ে ৪০-৪৫ মণ হারে ফলন পেয়েছি। এই জাতের ধানের বর্তমান বাজার দর ১৪০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা প্রতি মণ। ফলন ভালো হওয়ায় প্রতিবছর সেন্টু-শাইল ও সেন্টু-পাইজাম ধান আবাদ করি।

ধান ব্যবসায়ী মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বাজারে বর্তমানে সেন্টু-পাইজাম ও ইন্ডিয়ান পাইজাম ধান ব্যাপকহারে আসায় আমরা সেই ধানই কিনছি। তবে সেন্টু-পাইজাম ধানের চাহিদা বেশি। আর সেন্টু-আতপ এখন শেষের দিকে। আতপ ধান আমরা ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায় কিনেছিলাম।

সেন্টু হাজংয়ের এই গবেষণা সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অবগত থাকলেও কোনো প্রণোদনা ও সহযোগিতা পৌঁছায়নি তার ঘরে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সমন্বয়ের আশ্বাস জানিয়েছেন খামারবাড়ির কর্মকর্তারা।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবীর বলেন, কৃষক সেন্টু হাজং নিজ উদ্যোগে দেশি জাতের ধান উদ্ভাবন করে নালিতাবাড়ীতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। স্থানীয়ভাবে কৃষিতে অবদান রাখার জন্য উদ্ভাবক হিসেবে তিনি যেন পুরস্কৃত হন সেজন্য তার নাম কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।