এইচএসসি পাসের আগেই এমআইটিতে সুযোগ পেলেন নাফিস
এইচএসসি পাসের আগেই বিশ্বসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন চাঁদপুরের নাফিস উল হক সিফাত। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবেন তিনি। গত বুধবার (১৫ মার্চ) এমআইটি থেকে পাঠানো এক ই-মেইলে নাফিসের ভর্তির সুযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
চাঁদপুর শহরের চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় বাবা-মার সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন নাফিস। তার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষকতা করেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। নাফিসের বাবা মো. নাসির উদ্দিন মতলব রয়মনেনসা মহিলা কলেজের শিক্ষক। আর মা কামরুন নাহার হাজীগঞ্জ মডেল কলেজের শিক্ষিকা। নাফিসের গ্রামের বাড়ি মতলব দক্ষিণ উপজেলার নওগাঁ গ্রামে। তার বড় বোন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসিতে পাস করেন নাফিস। ছোটবেলা থেকে গণিতের প্রতি আলাদা আসক্তি রয়েছে তার। ভবিষ্যতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এরইমধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গণিতসহ বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে পেয়েছেন পদকও। বাংলাদেশি পড়ুয়াদের মধ্যে নাফিজ সবচেয়ে কম বয়সে এইচএসসিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় এমআইটিতে স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।
এদিকে নাফিসের এমন সফলতায় তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ, চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অসিত বরণ দাসসহ অনেকে। গত শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে এই শুভেচ্ছা জানানো হয়।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে নাফিস উল হক সিফাত বলেন, আমি অনেক আনন্দিত। যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এমআইটিতে ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছিল না। তবে আমি খুব লাকি যে আমি সেখানে সুযোগ পেয়েছি।
তিনি বলেন, আমি যেহেতু বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছি তাই আমার এই কমিউনিটির অনেক বড় ভাইদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। তারা অনেক হেল্পফুল। তাদের কাছ থেকেই আমি অনুপ্রেরণা নিয়ে মূলত এমআইটিতে আবেদন করি। অলিম্পিয়াড কমিউনিটির বড় ভাই যারা আছেন তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন আবেদন করতে। মূলত যারা আগে ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড বা অন্য অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের কাছ থেকেই জানা হয় কীভাবে আবেদন করতে হয় বা প্রসেস কী? তাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি আমি।
বাবা-মায়ের বিষয়ে নাফিস বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার বাবা-মা খুবই সাপোর্টিভ ছিলেন। কারণ আমি যখন অলিম্পিয়াড করতাম তখন দেখা যেত আমি সারারাত জেগে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতাম। আমি অনেককে চিনি যার বাবা-মা এগুলো এলাউ করে না। তবে আমার বাবা-মা সবসময় আমাকে এলাউ করেছে। সব সময় সব বিষয়ে আমার পুরো ফ্যামিলি আমাকে শতভাগ সাপোর্ট করেছে।
এমআইটিতে সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে নাফিস বলেন, আমি যতটুকু দেখেছি এখন পর্যন্ত যারাই এমআইটিতে সুযোগ পেয়েছেন তারা কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডের পদকধারী। আমি মনে করি, আমি অনেক লাকি। কারণ আমি ২০২১ ও ২০২২ সালে বাংলাদেশকে ইনফরমেটিক্স ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াডে রিপ্রেজেন্ট করেছি। ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিক্সে (আইওআই) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করি। সেখানে আমি দুটি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছি। প্রাথমিকভাবে আমার মনে এই প্রতিযোগিতাটি আমাকে এমআইটিতে সুযোগ পেতে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। এছাড়া বেশকিছু এক্সাম দিতে হয়। তাছাড়া একাডেমিক ক্লাসের রেজাল্টগুলো জমা দিতে হয়। সবগুলো বিচার বিবেচনা করে তারা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করে আমাকে জানিয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখনই আমার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। তবে আমি কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চাচ্ছি। সেখান থেকে আমি গবেষণা লাইনে যেতে চাই। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার পছন্দের বিষয় ছিল গণিত। গাণিতিক বিষয়গুলো সমাধান করতে আমি খুব পছন্দ করতাম। তখন থেকেই আমি গণিত ও ইনফরমেটিক্স সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করতাম। আমি মনে করি, আমার লাইফে কয়েকজন মানুষের অবদান অনেক বেশি। যেমন জাফর ইকবাল স্যার, শ্রদ্ধেয় কায়কোবাদ স্যার, সোহেল রহমান স্যার, মাহমুব মজুমদার স্যার। আমি ছোটবেলায় তাদের দেখতাম আর ভাবতাম, স্যাররা আমাদের জন্য কতকিছু করেন। আমি আসলে সবসময় স্যারদের মতো হতে চেয়েছি। সবসময় স্যারদের অনুসরণ করি এবং ছোটবেলা থেকে আমি অনেক অলিম্পিয়াডে অংশ নেই।
নাফিস বলেন, আমি এমআইটিতে চান্স পাওয়ার জন্য আলাদা তেমন কোনোকিছু করিনি। সবসময় আমার যেটা ভালো লাগতো আমি সেটাই করেছি। তবে সব শিক্ষার্থীর মধ্যেই কিছু না কিছু আছে যা তার কাছে খুবই ভালো লাগে। এমআইটি মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়গুলো খুবই গুরুত্ব দেয়। যেমন গবেষণা করা, অলিম্পিয়াড করা বা বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট করা। তো একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি যারা এইগুলো করতে পারে তাদের এমআইটিতে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
তিনি আরও বলেন, পড়ালেখার ক্ষেত্রে আমি কখনোই কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়িনি। আমার স্কুল, কলেজের সবাই খুবই সাপোর্টিভ ছিল। এমনও হয়েছে আমার কলেজে কোনো পরীক্ষা চলছে কিন্তু আমার কোনো ক্যাম্প আছে, তাই কলেজ থেকে আমাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আমি পড়ালেখার ক্ষেত্রে কখনোই কোনো সমস্যা পাইনি।
এক আলাপচারিতায় নাফিসের সাবেক শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, নাফিস অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই আমি তার ভেতরে সৃজনশীল কিছু করার প্রতিভা দেখেছি। সে সবসময় প্রযুক্তি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতো। সে পড়ালেখার পাশাপাশি মোবাইল ও কম্পিউটারে সময় দিতো। আজকে এই প্রযুক্তি তাকে এতটুকু নিয়ে এসেছে বলে আমি মনে করি। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।
চাঁদপুর সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক অসিত বরণ দাস বলেন, আমাদের কলেজের নাফিস এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সেটা তার চেষ্টা ছিল। কারণ সবসময় তার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা বা গবেষণার আগ্রহ ছিল। সেটারই প্রতিফলনে এটা হয়েছে। শুধু আমার কলেজে নয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরকম অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা অনেক প্রতিভাবান।
তিনি আরও বলেন, নাফিস সবসময় একটি ভিন্ন চিন্তা-চেতনার মধ্যে ছিল। তার মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি ছিল। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যা অত্যন্ত প্রয়োজন। নাফিস যেভাবে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে নিজেকে বিকশিত করতে পেরেছে। এমন প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে আরও অনেক শিক্ষার্থীকে বিশ্ব দরবারে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ দেবে আমি মনে করি।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি নাফিসকে শুভেচ্ছা জানানোর সময় বলেন, নাফিস শুধু চাঁদপুরের নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। কারণ নাফিস এদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমি তার সফলতায় সবসময় পাশে থাকবো।
নজরুল ইসলাম আতিক/এমআরআর/জেআইএম