অসহায় পুলিশ

অভিযান-মামলায়ও থামছে না তিন চাকার যান

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৭:৪৭ পিএম, ১৫ মার্চ ২০২৩

উত্তরাঞ্চল মহাসড়কে এখন বড় বিপদ ত্রিচক্র যান। দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে গতির পাল্লা দিয়ে চলছে এই ঝুঁকিপূর্ণ বাহনগুলো। শুধু তাই নয়, এসব অবৈধ যানের স্ট্যান্ডও করা হয়েছে মহাসড়কের ওপরই। প্রধান সড়কগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি দেখা যাচ্ছে তিনচাকার যানবাহনের রাজত্ব।

বগুড়াসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলার মহাসড়কে গত তিন বছরে সিএনজি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ভটভটি দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুই শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে দুজন করে মানুষ মারা যাচ্ছে এবং সাতজন আহত হচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশ, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বেসরকারি একাধিক এনজিওর তথ্য থেকে মিলেছে এই চিত্র।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, সরকারি আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে ইজিবাইক, সিএনজিসহ অন্য থ্রি-হুইলার। অতীতের চেয়ে এই চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে অহরহ দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে সড়কে অরাজকতা কমবে না।

হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়নের পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, তাদের সব রকমের চেষ্টার পরেও মহাসড়কে ত্রিচক্র যান চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। তারা প্রতিনিয়ন অভিযান চালাচ্ছেন, চালকদের সচেতন করছেন, মামলা দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও এই যানের দৌরাত্ম কমছে না। উল্টো মহাসড়কে থাকা পুলিশ সদস্যরা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, মহাসড়ক নিরাপদ করতে হলে এখন পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও উদ্যোগ নিতে হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের শাজাহানপুর উপজেলা অংশে মহাসড়ক দখল করে থাকে নিষিদ্ধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এই সড়কেই রয়েছে সিএনজির একাধিক অবৈধ স্ট্যান্ড। সেখানে এলোমেলোভাবে পার্কিং করা হচ্ছে শতশত অটোরিকশা।

যাত্রীরা বলছেন, মহাসড়কে অটোরিকশা ওঠা নিষিদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার তিনজনের আসনে বসছেন পাঁচজন। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা করা হচ্ছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

আব্দুল কাদের নামে এক অটোরিকশাচালক বলেন, বগুড়া থেকে বিভিন্ন রুটে অন্তত তিনশ অটোরিকশা চলাচল করে। মহাসড়কের উভয়পাশ দিয়ে বগুড়া শহর এবং অন্য উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের শাখা সড়ক আছে। এতে সময় একটু বেশি লাগে, তবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু রিজার্ভ না নিলে কেউ ছোট সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে না। মহাসড়কেই চলাচল করে।

উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রামের কুন্দারহাট ও গোবিন্দগঞ্জের ফাঁসিতলায় রয়েছে হাইয়ের পুলিশের থানা ও ক্যাম্প। অভিযোগ রয়েছে এসব থানা ও পুলিশ ক্যাম্পে দায়িত্বরত কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে অবৈধ যানবাহনকে মহাসড়কে চলাচলের সুযোগ দিয়ে থাকেন। যার কারণে গোপনে নয়, বরং প্রকাশ্যে শোডাউন করে দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেন তারা। গতির দিক থেকেও বাস-ট্রাককে পেছনে ফেলে রীতিমতো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। আর বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় যাত্রীদের।

অটোরিকশার যাত্রী শেরপুরের মীর্জাপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, মহাসড়কে চালকরা কারও কথা শোনেন না। তারা কেউই প্রশিক্ষিত নন। যাত্রীদের অনুরোধ উপক্ষো করে দ্রুতগতিতে চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।

আমেনা বেগম একটি এনজিওতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, মহাসড়কে মাঝে মাঝে পুলিশকে তৎপর হতে দেখি। এটা হঠাৎ কেন আবার বন্ধ হয়ে যায়, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। আসলে পুলিশের সঙ্গে চালকদের একটা মাসিক চুক্তি আছে। এটা অনেক চালক অবলীলায় স্বীকারও করেন। আবার কেউ স্বীকার করেন না। কিন্তু আমরা যারা নিয়মিত যাত্রী তারা মহাসড়কে পুলিশের এই হঠাৎ তৎপরতা বেশ ভালোই বুঝি। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে ঝুঁকি অনেক কমে যেত।

শেরপুরের ধুনট মোড় এলাকার বাসিন্দা আকবর মিয়া বলেন, সকাল সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত স্ট্যান্ড এবং বাজারের মুখগুলোতে সিএনজি অটোরিকশা ঠাসাঠাসি করে থাকে। তিনজনের বসার আসন থাকলেও পাঁচজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলে আসছে। অথচ এই মহাসড়ক দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১১টি জেলার শতশত ভারী যানবাহন চলাচল করে। পাশেই হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা বিষয়গুলো দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বগুড়ার শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জয়নাল আবেদিন বলেন, মাসিক কোনো চুক্তি করা হয় না। আমরা সিএনজির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। মামলা দিচ্ছি। আসলে এরা পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে চলাচল করে।

দেশের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে সব মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, অটোটেম্পু ও সব শ্রেণির অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করে সরকার। আদেশ জারির পর পুলিশ অভিযান চালালেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে।

মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, মূলত বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকেই এই সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অবাধ চলাচল রয়েছে। সেখান থেকে হাটিকুমরুল মোড় হয়ে নাটোরের বনপাড়া রোড, দক্ষিণে শাহজাদপুর হয়ে পাবনা রোড, উত্তরে চান্দাইকোনা হয়ে বগুড়ার বনানী রোড, শাকপালা নন্দীগ্রাম হয়ে নাটোর রোড, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে শহরের বিভিন্ন সংযোগ রোড, বগুড়ার চারমাথা হয়ে সান্তাহার রোড, মাটিডালি হয়ে দ্বিতীয় বাইপাস এবং শিবগঞ্জ ও মোকামতলা রোড হয়ে জয়পুরহাট, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বিভিন্ন রোড ছাড়াও পলাশবাড়ি, পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর থেকে রংপুর মডার্ন মোড় পর্যন্ত অবাধে চলছে থ্রি-হুইলার যানবাহন। এছাড়া এই রুটে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মহাসড়কে অবাধে চলাচল করে এই ঝুঁকিপূর্ণ যান।

আর ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের বগুড়ার অংশের মধ্যে বনানী, বেতগাড়ী, লিচুতলা, সাজাপুর, টিএমএসএস ফিলিং স্টেশন, শাজাহানপুর নতুন থানা ভবন, উপজেলা পরিষদ, শাজাহানপুর বন্দর এলাকা, আড়িয়া বাজার, নয়মাইল, শেরপুরের জামালপুর, দশমাইল, গাড়ীদহ, দুগ্ধ ও প্রাণী উন্নয়ন খামার, মহিপুর বাজার, হাজীপুর, কলেজরোড, উপজেলা পরিষদ, আহলে হাদিস পাক মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, খেজুরতলা, ধুনট মোড়, হামছায়াপুর, কাঁঠালতলা, শেরুয়া, শেরুয়া বটতলা, মৎস্যখামার, যমুনাপাড়া, কৃষ্ণপুর, মদনপুর, মির্জাপুর, রানীরহাটমোড়ের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায়ই দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।

বগুড়া জেলা অটোটেম্পু, অটোরিকশা ও সিএনজি পরিবহন মালিক সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি আসাদুর রহমান দুলু দাবি করেন, এ জেলায় সবমিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার থ্রি-হুইলার সড়ক ও মহাসড়কে চলাচল করে। এতে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তবে আমরাও চাই এটা চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এ বিষয়ে সবার আগে মহাসড়কে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

সম্প্রতি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা সদরে গিয়ে দেখা গেছে, অন্ধকার মহাসড়কে শুধু সিএনজি অটোরিকশা নয়, ব্যাটারি ও পায়েচালিত রিকশা-ভ্যান চলাচল করছে। তাদের বেপরোয়া গতিতে চলাচলের কারণে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিআরটিএ বগুড়া অফিসের সহকারী পরিচালক মাইনুল হাসান বলেন, দেশের ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে সরকারি নির্দেশ রয়েছে। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করা হয়। অনেক সময় মহাসড়কে গিয়ে কোনো থ্রি-হুইলার গাড়ি দেখা যায় না। আবার কখনো কখনো এত গাড়ি থাকে যে অভিযান চালাতে আমাদের হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।