এবারও ফসল হারানোর ভয় হাওরের কৃষকদের
সুনামগঞ্জ জেলায় বছরে একটি মাত্র ফসল হয়। এই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ওই একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৭ সালে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে আগাম বন্যায় শতভাগ ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। সেবার পুরো জেলায় খাবারের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। এরপর ২০২২ সালেও আগাম বন্যায় জেলার ১০ উপজেলায় ২৩টি বাঁধ ভেঙে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
মূলত ২০১৭ সালে শতভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেলে সরকার নড়েচড়ে বসে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে সুনামগঞ্জের হাওরের বাঁধের কাজের তদারকি করা হয় এবং বাঁধের কাজে বরাদ্দও বেশি দেওয়া হয়। প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামতের কাজ ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা। এ বছরও ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু হয় কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ৭ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। ৭ মার্চও বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়েছে কিন্তু এই সময়ে এসেও শতভাগ কাজ শেষ হয়নি। আর এতেই আতঙ্কিত হাওরের কৃষকরা।
আরও পড়ুন- ব্যাংক ঋণে ‘ভোগান্তি’, এনজিওতে ঝুঁকছেন হাওরের কৃষক
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধের কাজ ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বললেও হাওর নেতাদের দাবি এখন পর্যন্ত হাওরে ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় সরকার এবার সুনামগঞ্জের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের পরিধি এবং বরাদ্দ বাড়িয়েছে। এ বছর ৭৪৫ কিলোমটিার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামতের কাজের জন্য ২০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা গত বছর ছিল ১২৩ কোটি টাকা। ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়নের জন্য পিআইসি বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। এ বছর ১০৭৬টি পিআইসি কাজ করছে। তবে এই পিআইসি গঠন নিয়েও স্থানীয় কৃষক ও হাওর নেতাদের অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধর্মপাশার গাগলাখালি, শয়তানখালি, মধ্যনগরের আবিদনগর বাজার সংলগ্ন বাঁধ, জিনাইরা বাঁধ, তাহিরপুরের মহালিয়া হাওরের ১৯ ও ১৪ নম্বর প্রকল্প, মাটিয়ান হাওরের বনোয়া বাঁধ, জামালগঞ্জের হালির হাওরের পুরাতন গনিয়াখাড়া, দোয়ারাবাজারের নাইন্দার হাওরের ২, ২৮ ও ৩৫ নম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। শাল্লায় ভান্ডা বিল হাওরের ৩৪ ও ভেড়া মোহনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ এবং জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরের ১, ৯, ১০, ১১, ১৪ ও ১৮ নম্বর পিআইসির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
বেশিরভাগ বাঁধ শক্তিশালী করতে বাঁশের আড় ও বস্তা দেওয়ার কোনো আলামত চোখে পড়েনি। এমনকি তাহিরপুর উপজেলার ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২ প্রকল্পের মাটির কাজও শেষ হয়নি। এছাড়া বাঁধ টেকসইয়ে ঘাস ও দুরমুশের কাজও অবশিষ্ট আছে।
আরও পড়ুন- বাঁধের নামে কাটা পড়লো টাঙ্গুয়ার হাওরের ৫০ হিজল গাছ
কৃষকরা জানান, অসময়ে দেওয়া দুর্বল বাঁধ পানির বড় ধাক্কা সামলাতে পারবে না। বাঁধের মাটির কমপেকশন হওয়ার আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হবে। বাঁধ তখন ধসে পড়ার বা ভাঙার আশংকা থাকবে। আমরা ধান ঘরে তোলা নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।
মাটিয়ান হাওরের কৃষক রবি মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, মাটিয়ান হাওরে এখনো মাটি ফেলার কাজও শেষ হয়নি। কয়েকদিন পর বৃষ্টি শুরু হবে। এখন হাওরের ধান ঘরে তোলা নিয়ে চিন্তায় আছি।
হাওরের কৃষি ও কৃষকরক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, জেলাজুড়েই এমন অবস্থা। অনেক বাঁধেই দায়সারাভাবে মাটি ফেলে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ না করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি কাজ সমাপ্ত করে দিয়েছে। এটা সত্যি দুঃখজনক।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবু সুফিয়ান জাগো নিউজকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু দুই দফা সময় বাড়িয়েও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাওরে মাত্র ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে। শুধু তাই নয়, হাওরের বাঁধে নিম্নমানের কাজ করায় এখন বৃষ্টি শুরু হলে বৃষ্টির পানিতেই বাঁধ ভেঙে যাবে।
আরও পড়ুন- যাদুকাটার তীরে টুকটুকে শিমুল বাগানে পর্যটকের ভিড়
তবে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, হাওরের বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে। ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। আর ৩ থেকে ৪ দিনের ভেতরে হাওরের পুরো বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের তদারকি করা হচ্ছে। যদি বাঁধের কাজে কারো গাফিলতি থাকে বা অনিয়ম ধরা পড়ে তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এফএ/জেআইএম