গল্পটা সংগ্রামী শিউলির
শিউলি আক্তারের বয়স ৩৭। তার জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে আছে সংগ্রাম আর কষ্টের গল্প। সংগ্রামী এ নারীর বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের চাঁদখালী গ্রামের ছোটপুল এলাকায়।
১৪ বছর আগে শিউলির স্বামী আবদুর রহিম লিভার ক্যানসারে মারা যান। ছোট ছেলে ইয়াসিনের বয়স তখন দেড় মাস। মেয়ে আঁখি বাবার মৃত্যু বুঝতে পারলেও অনাগত দিনে কী হবে, তাতে ছিল অবুঝ। স্বামীর মৃত্যুতে শিউলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। নিজের এবং সন্তানদের কী হবে, কোথায় কার কাছে যাবে, এমন অজানা হাজারও প্রশ্ন শোকার্ত মনে উঁকি দিয়েছিল।
এদিকে, স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার থেকে শিউলিকে অন্যত্র বিয়ের জন্য বারবার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে সায় দেননি তিনি। ছেলেমেয়ের মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর বিয়ের কথা চিন্তা করেননি। বিধবা হওয়ার পর থেকেই সন্তানদের মলিন মুখে হাসি ফোটাতে শিউলি রাত-দিন লড়ে যাচ্ছেন।
শিউলির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম অবস্থায় তিনি গ্রামে আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতেন। সেখান থেকে ছেলেমেয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। একপর্যায়ে মানুষের দেওয়া খাবারে সংসার চলছিল না। বাড়িতে কাজ করলে খাবার ছাড়া টাকা দেওয়া হয় না। শিউলি বুঝতে পেরেছেন, এভাবে সন্তানদের মানুষ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কৃষিক্ষেতে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করেন তিনি। ক্ষেতে কাজ করে দিনে ৩০০-৫০০ টাকা পাওয়া যায়।
এখনো কৃষি শ্রমিকের কাজ করে সংসার চলে তার। কিন্তু মৌসুম শেষে তাকে খুব কষ্টে সন্তানদের নিয়ে দিন পার করতে হয়। তাদের পড়াশোনার খরচ চালানোও যেন ‘নিত্য বোঝা’। তবুও সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কষ্ট করে যাচ্ছেন শিউলি। কিন্তু স্বামীহীন সংসারে দারিদ্র্যতা প্রধান বাধা। উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় সংসার একাই সামাল দিতে হয়। এর মধ্যে বৃদ্ধ শাশুড়ির ভারও তার কাঁধে।
সরেজমিনে শিউলির বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তপ্ত রোদের মধ্যে তিনি বাড়ির উঠানে কাজ করছেন। ঘেমে একাকার। ঘরের দরজায় শাশুড়ি বসে আছেন। বাড়িতে তার দোচালা একটি ঘর, তাও জরাজীর্ণ। বৃষ্টি এলেই ওপর থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ে। উঠানের পূর্বপাশে রান্নাঘরটাও জরাজীর্ণ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শিউলি সাহসী এবং পরিশ্রমী। তার মেয়ে আঁখি আক্তার রুমি স্থানীয় বাইশমারা মডেল একাডেমির নবম শ্রেণির ছাত্রী। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিদ্যালয়ের প্রথম স্থান অর্জনকারী আঁখি। ছেলে ইয়াসিন আরাফাত দক্ষিণ লাহারকান্দি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
আঁখি আক্তার রিমু বললো, আমাদের লালনপালন করতে মাকে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পড়াশোনা করে একদিন আমি মায়ের দুঃখ লাঘব করবো। আমাদের চাওয়া পূরণ করতে না পারলে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করেন।
শিউলি আক্তার বলেন, অন্য জায়গায় বিয়ে করলে আমি স্বামী পেতাম। কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে তো বাবার মতো মাকেও হারাতো। এটি কখনো আমি সহ্য করতে পারবো না। আমার পৃথিবী ছেলেমেয়ে। তাদের সব আবদার পূরণ করতে না পারলে খুব কষ্ট হয়।
তিনি বলেন, মৌসুমজুড়ে মানুষের ক্ষেতে কাজ করে যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে কষ্ট হয়। বৃষ্টি এলে ঘরের চালা দিয়ে পানি পড়ে। তারপরও ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে কোনোরকমে দিন কেটে যায়।
পুত্রবধূ সম্পর্কে শাশুড়ি চম্পা বেগম বলেন, ‘হোলা (ছেলে) মরার হরের তন (পর থেকে) বউ আঁরে
খাওয়াইতাছে। বউরে বাপের বাড়ির মাইনসে (লোকজন) লই যাইতো চাইছে। হোলা-মাইয়ার চেরার (চেহারা) দিকে রেনি (চেয়ে) আর যানো (যায়নি)। আঁর হোলা মরি যানের হর ধরি বউগার কষ্ট করিই দিন যাইতাছে।’
দক্ষিণ লাহারকান্দি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক রিয়াদ হোসেন বলেন, শিউলির ছেলে ইয়াসিনকে মাদরাসায় বিনামূল্যে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কষ্টের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা অব্যাহত রেখেছেন তা প্রশংসনীয়। সত্যিই তিনি একজন সংগ্রামী মা।
বাইশমারা মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক আহছান উল্যাহ বলেন, আঁখি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া খুবই প্রতিভাবান ছাত্রী। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রথম স্থানে নিজেকে ধরে রেখেছে। তার মা খুবই কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছেন। আশা করি, মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত হিসেবে আঁখি একদিন সফল হবে।
এমআরআর/এমএস