বয়স বাইশ
ভাঙারি কুড়িয়ে জীবন চলে স্বামীহারা শাবনূরের
শাবনূরের বয়স মাত্র বাইশ। কৈশোর পেরোনোর আগেই দেখেছেন সন্তানের মুখ। সাত বছর আগে হারিয়েছেন স্বামীকে। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের অলিগলি থেকে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও লৌহদ্রব্য কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়েই চলছে সংসার।
জামালপুর শহরের মুসলেমাবাদ এলাকার বাসিন্দা শাবনূর। শিহাব নামে তার আট বছরের এক ছেলে আছে।
নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে শাবনূর বললেন, ‘হেই কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম, হের পর আর চোখে দেহি নাই। পোলাডা পরাই (প্রায়) বায়না ধরে গোশত খাবো কিন্তু খাওয়ামু কিবাই (কীভাবে)! ভাঙারি বেইচা তার পড়ালেহা আর সংসার চালানোই হিমশিম খাই’।
জানা গেছে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকার তোফাজ্জল ও আয়েশা বেগম দম্পতির মেয়ে তিনি। অভাবের সংসারে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই একই উপজেলার রুবেল মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেন বাবা-মা। বিয়ের তিন বছর পর থেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন স্বামী। এরইমধ্যে কোল আলো করে জন্ম নেয় ছেলে। সন্তানের বয়স যখন এক বছর বয়স তখন মারা যান স্বামী রুবেল। তার মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি। দু-বেলা দুমুঠো ভাতের অন্বেষণে দিগ্বিদিক ঘুরতে থাকেন, অবশেষে চলে আসেন জামালপুর শহরে।
শাবনূর জানান, তার স্বামী ভাঙারির ব্যবসা করতেন। তিনিও সেই কাজে সহযোগিতা করতেন। সেই থেকে তার মাথায় চিন্তা আসে ভাঙারির ব্যবসায় নামার। কিন্তু হাতে বিনিয়োগের মতো টাকা না থাকায় নিজেই নেমে পড়েন পুরাতন ভাঙাচোরা মালামাল কুড়াতে। একটা ভ্যানগাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহর এবং এর আশপাশে পুরাতন ও পরিত্যক্ত লোহা, টিন, প্লাস্টিক, বোতল, বই, খাতা, পেপার কুড়ান এবং কমদামে পেলে কেনেন। দিনশেষে ২০০-২৫০ টাকায় পুরাতন মালামালগুলো মহাজনের কাছে বিক্রি করেন।
তিনি জানান, মুসলেমাবাদ এলাকায় একটি ঝুপড়ি ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলেসহ বসবাস করেন। যার মাসিক ভাড়া দিতে হয় এক হাজার টাকা। সঙ্গে পাঁচশ টাকা বিদ্যুৎ বিল। ছেলে মুসলেমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। সামান্য আয়ের টাকা থেকে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দুবেলা দুমুঠো ভাত মুখে দিতেই হিমশিম খান। কালেভদ্রে ছোট সাইজের পাঙাশ মাছ কেনার সাধ্য হয়, তাও অতিকষ্টে।
শাবনূর আরও জানান, নারী হয়ে নিজে ভ্যান চালিয়ে ঘোরেন বলে প্রায়ই মানুষের কটূকথা শুনতে হয়। তবুও অন্যের কাছে হাত পাতেননি কখনো। সরকার বা কোনো সংস্থা তার ব্যবসা দাঁড় করানোর মতো কিছু বিনিয়োগ ও ভ্যানগাড়ি কেনায় সহযোগিতা করলে তিনি ছোটখাটো একটি ব্যবসা দাঁড় করাতে চান।
শাবনূরের বিষয়ে কথা হয়েছিল প্রাবন্ধিক ও কবি জাকারিয়া জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা লাইমলাইটে উঠে আসা নারীদের কথা তুলে ধরি, কিন্তু সমাজের পিছিয়ে থাকা; সম্ভাবনাময়ী ও জীবনযোদ্ধা নারীদের ক্ষেত্রে তেমন প্রচার ও সহযোগিতা লক্ষ্য করি না। শাবনূর এমনই একজন সংগ্রামী নারী, যিনি সচ্ছলতার জন্য অন্যের দ্বারস্থ কিংবা অন্যায়ের পথে পা বাড়ানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা করেননি। নিজে ভ্যান চালিয়ে পরিত্যক্ত দ্রব্য কুড়িয়ে আয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা আছে, যারা চাইলে শাবনূরের জন্য স্থায়ী একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।
জামালপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাজু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, তিনি বিধবা হয়ে থাকলে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এজন্য তাকে অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
জামালপুর মহিলা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কামরুন্নাহার জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের লড়াকু নারীদের রোকেয়া দিবসে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। যেহেতু তার বিষয়ে জানা নেই, শাবনূর যোগাযোগ করলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।
এমআরআর/এএসএম